রবিবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৭ পূর্বাহ্ন

‘মৃত্যু হয়নি, আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে

সিনিয়র রিপোর্টার / ৩৬৭ Time View
Update : শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৩

প্রকৃতির নিয়মেই পৃথিবীতে মানুষ আসে আবার প্রকৃতির নিয়মেই ছেড়ে যেতে হয়। তবুও যেন মানব জীবনে চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই। তারপরও এক সময় প্রিয়জনকে চিরতরে হারাবার কষ্ট; শোকাহত মানুষকে প্রকৃতির নিয়মেই যেন মেনে নিতে হয়। তবে কিছু কিছু মৃত্যু, কিছু কিছু হারাবার বেদনার গভীরতা এতটাই থাকে, যা কোন ফ্যাদোমিটারে মাপা সম্ভব হয় না; যে বেদনা থেকে যায় সারাজীবন। সম্প্রতি তেমনি একজন পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর করুণ কাহিনী সকলের মনে দাগ কেটেছে গত ২৮ অক্টোবর। অর্পিত দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় স্বামী মো: আমিরুল ইসলাম পারভেজকে দিবালোকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে দাবি করেছেন স্ত্রী রুমা আক্তার।
কথা হয় মেয়ে তানহা ইসলামের (৫) সঙ্গেও। কথা বলে জানা যায়, তানহা ইসলাম এখনো দরজার পাশে দাড়িয়ে অপেক্ষা করে তার বাবা অফিস শেষে বাসায় ফিরে আসবে। তাকে নিয়ে চকলেট কিনতে দোকানে নিয়ে যাবে, ছুটির দিনে নিয়ে যাবে ঘুরে-বেড়াতে। রাস্তায় পুলিশ সদস্যদের দেখে মায়ের কাছে প্রশ্ন রাখে-এতো পুলিশ কাকাকে দেখি কিন্তু আমার পুলিশ বাবাটা কোথায়? মেয়ের মুখে এমন প্রশ্নের উত্তর মায়ের কাছে অজানা। বাবাকে মিস করছে কিনা বলা মাত্রই কান্না জড়িত কণ্ঠে; তানহা ইসলাম বলে, ‘ওরা আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে। আমি আমার বাবাকে ফিরে পেতে চাই; বাবাকে জড়িয়ে ঘুমাতে চাই। কোথায় গেলে বাবাকে পাওয়া যাবে আঙ্কেল বলে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। শুধু তাই নয় ছোট্ট মেয়ে এখন টাকা জমাচ্ছে তার বাবাকে কিনে আনবে বলেও।’
গত শনিবার ৯ ডিসেম্বর দৈনিক সোনালী বার্তাকে নিহত পুলিশ সদস্য আমিরুল ইসলাম পারভেজ এর স্ত্রী রুমা আক্তার বলেন, ‘কেন তুমি আমাকে একা করে দিয়েছ? তুমি ছিলে আমার জীবনের সেরা পাওয়া। তুমি সবসময়, প্রতিটি সেকেন্ড আমাকে পরিপূর্ণ করেছ। তুমি প্রতি মুহুর্তে আমার বেঁচে থাকার কারণ। সেই তুমি কেন এভাবে সারাজীবনের জন্য আকাশে লুকিয়ে গেলে? তোমার একমাত্র রাজকন্যা তানহা ইসলামকে আমি কিভাবে সান্তনা দেব; তোমার স্বপ্ন এখন আমি কিভাবে বাস্তবায়ন করবো। কিভাবে চলবে আমাদের জীবন।
তিনি বলেন, ১০ বছরের দাম্পত্যজীবন একটি ফোন কলে শেষ হয়ে যাবে মেনে নিতে পারছি না। তিন বছর ধরে রাজধানীর শাহজানপুরে একমাত্র কন্যা তানহা ইসলামকে নিয়ে বসবাস করছিলাম। প্রতিদিনের মতো গত ২৮ অক্টোবর সকালে আমার স্বামী ফজরের সময় ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়েছেন। প্রতিদিন আমি সকালের নাস্তা তৈরি করে দেই; কিন্তু ২৮ অক্টোবর আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি সে রুমের ভেতরে পায়চারী করছে। ঘুম থেকে কখন উঠেছে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর আসে; উঠেছি অনেক আগেই- আমি নাস্তাও করে ফেলেছি কিছুক্ষণের মধ্যে ডিউটিতে চলে যাব। অথচ প্রতিদিন এক সঙ্গে নাস্তা করেছি। মেয়ে তখনও বিছানায় ঘুমে কাতর। মেয়েকে ঘুমন্ত অবস্থায় কপালে আদর দিয়ে চলে যাওয়ার সময় বলে যায়- দরজাটা লাগিয়ে দাও। আগের দিন অর্থ্যাৎ গত ২৭ অক্টোবর রাতে বাসায় ফিরে বলেছিল; সারাদিন ডিউটি করেছি কাল সকালে আবারও ডিউটি দিয়েছে; এখন ঘুমিয়ে পড়ো সকাল সকাল উঠতে হবে। ফলে রাতে তেমন আর কোনো কথা বলার সুযোগ হয়নি।
২৮ অক্টোবর দিনের বেলায় স্বামীর সঙ্গে শেষ কি কথা হয়েছিল প্রশ্নে রুমা আক্তার বলেন, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মেয়ে তানহা বলল; আম্মু আমার আব্বুকে একটা কল দাও। আমি ফোন কল দিলে মেয়ের সঙ্গে কথা বলে; মেয়ে বলছিল বাবা তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসো; মেয়ের বাবাও বলল- মা (মেয়ে) আমি ডিউটি শেষ হলে তোমার কাছে দ্রুত চলে আসবো। তখন আমার সঙ্গে আর কোনো কথা হয়নি। পরবর্তীতে বেলা দুইটার দিকে আবার ফোন দিলে কথা হয় আমার সঙ্গে। আমি বলেছিলাম কোথায় ডিউটি পড়েছে তখন জানায় নয়াপল্টন এলাকায়; দোয়া করিও। দুপুরে খাবার খাওয়া হয়েছে কিনা বললে উত্তর দেন; কয়েক মিনিটের মধ্যে খাবার খেতে যাব; এটাই আমার সঙ্গে তার (স্বামী) শেষ কথা।
স্বামীর মৃত্যুর খবর কিভাবে জানতে পেয়েছেন প্রশ্নে তিনি বলেন, ২৮ অক্টোবর দুপুর আড়াইটার দিকে টেলিভিশন ছেড়ে দেখি নয়াপল্টন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হচ্ছে। এরপর থেকে তাকে অনবরত ফোন দিয়ে গেলেও আর ফোন রিসিভ হয়নি, কিছুক্ষণ ফোন বন্ধ পাই। আমার কাছে তার কোনো ব্যাচমেটের ফোন নম্বর ছিল না যে আমি ফোন করে খোঁজ খবর নিব। তাকে ফোনে পাচ্ছি না; তখন আমার মনের মধ্যে যে তুফান শুরু হয়ছিল তা বলে বুঝানোর নয়। আমি যখন ছটফট করছি তখন আছরের দিকে একটি অচেনা নম্বর থেকে আমার ফোনে কল আসে আমি রিসিভ করতেই ওই পাশ থেকে বলে উঠেন; আমি আপনার স্বামীর ব্যাচমেট বলছি- আপনি কী আমিরুল ইসলাম পারভেজ ভাইয়ের স্ত্রী বলছেন; আমি বললাম জ্বী। তখন উনি বললেন; আপনার স্বামী আহত হয়েছেন, আপনি দ্রুত রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতালে চলে আসেন। আমি তখন মেয়েকে নিয়ে বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম; তখন তিনি আবার ফোন দিয়ে বললেন আপনি রাজারবাগ হাসপাতালে না এসে থাকার প্রস্তুতি নিয়ে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে চলে আসুন। তখন আমি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের সামনে গেলে অনেক ভিড় দেখতে পাই; তখন পুলিশ সদস্যদের পরিচয় দিলে উনারা আমার পরিচয় জানতে চেয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, আল্লাহ তুমি রক্ষা করো, এরপর ভেতরে গিয়ে দেখি আমার স্বামী আর বেঁচে নেই। তখন আমি ও আমার মেয়ে স্বামীর মুখটাও দেখতে পারিনি। এরপর আধাঘন্টা আমার জ্ঞান ছিল না; আমি উঠে দেখি আমার মেয়েকে একজন পুলিশ সদস্য কোলে নিয়ে তিনিও কান্না করছেন।
আমিরুল ইসলাম পারভেজ স্বামী হিসাবে কেমন ছিলেন; জবাবে রুমা আক্তার বলেন, আমার স্বামীর মতো দ্বিতীয় একটা আমিরুল দুনিয়ায় আছে কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। সে ছিল সহজ-সরল; কোনো প্রকার হিংসা ছিল না তার। সে ছিল স্ত্রীর ভালো স্বামী, সন্তানের ভালো বাবা, বাবা-মায়ের ভালো সন্তান।
এমন কোনো স্মৃতি আছে যা আপনাকে এখনো আবেগতাড়িত করে প্রশ্নে রুমা আক্তার বলেন, একদিন হঠাৎ করে সে (স্বামী) বলল; আমি-তুমি এবং একমাত্র মেয়ে আমরা যেন একসঙ্গে বাঁচি আর যদি মরতে হয় সেই মরণ যেন এক সঙ্গেই হয়। তখন আমি কিছু রাগ নিয়ে বললাম; তুমি হঠাৎ এমন কথা বলছো কেন? তখন সে বলল পৃথিবীতে আমার মতো তোমাদের ভালোবাসতে পারে এমন কেউ নাই। তোমাদের আগে আমার মৃত্যু হলে তোমাদের কষ্ট শেষ হবে না। অথচ আজ নিয়তি আমাদের কাছ থেকে তাকেই নিয়ে নিল; আর আমাদেরকে (মা-মেয়ে) করে গেছে শূণ্য।
স্বামীকে হারিয়ে কীভাবে দিন পার করছেন? তিনি বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে আমি এখন বাবার বাড়িতে থাকছি। আমার শ্বশুর একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা; দীর্ঘদিন ধরে ব্রেন স্টোকে অসুস্থ, ছেলে হারানোর কথা এখনো তিনি জানেন না। শাশুড়িও অসুস্থ হয়ে বিছানায়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি ছিল আমার স্বামী। এই মুহর্তে শ্বশুর বাড়িতে থাকার মতো পরিবেশও নাই। তাই বাবার বাড়িতেই থাকছি। মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়তে এক অশেষ লড়াইয়ে পড়েছি। ভাগ্য আমাদের এমন অভাগা; আল্লাহই এখন শেষ ভরসা। এই কঠিন পৃথিবীতে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে আর ফিরে পাবো না আমিরুলকে। তার চলে যাওয়ার যে শূন্যতা আমার ও আমার সন্তানের মধ্যে তৈরি হয়েছে, সেটা কোনোদিনই পূরণ হবে না। আমার বিশ্বাস, আল্লাহ আমার স্বামীকে শান্তিতে রেখেছেন। তিনি বলেন, আমার স্বামী আমাদের মেয়ে তানহা ইসলামকে পুলিশের একজন বড় কর্মকর্তা বানানোর স্বপ্ন দেখতো। প্রায়ই আমাকে বলতো; দেখ একদিন আমাদের রাজকন্যা পুলিশের বড় স্যার হবে।
পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো প্রকার সহায়তা পেয়েছেন কী জানতে চাইলে নিহত আমিরুল ইসলামের স্ত্রী বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আমার মেয়ের ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত পড়াশোনার দায়িত্ব তারা নিয়েছেন। এছাড়াও আমার স্বামীর মরদেহ নিয়ে বাড়িতে যাওয়ার সময় চার লাখ টাকা পেয়েছিলাম কিন্তু টাকা কে দিয়েছে জানি না। আর স্থানীয় সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয় এক লাখ টাকা দিয়েছেন। এ সময় স্বামীর মৃত্যু হয়নি হত্যা করা হয়েছে দাবি করে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে স্বামী হত্যায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।
এদিকে গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালনকালে নেতাকর্মীদের হামলায় নিহত পুলিশ সদস্য মো. আমিরুল ইসলাম পারভেজের পরিবারের পাশে দাঁড়ালো বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক (বিপিডব্লিউএন)। স্ত্রী ও সন্তানের ভরণপোষণ নির্বাহের লক্ষ্যে স্থায়ী আয়ের অংশ হিসেবে কমিউনিটি ব্যাংকে নিহত কনস্টেবল আমিরুলের স্ত্রীর নামে এক লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করেছে বাংলাদেশ পুলিশের নারী সদস্যদের কল্যাণে গঠিত এ সংগঠনটি। বৃহস্পতিবার ৩০ নভেম্বর ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্সের কনফারেন্স রুমে কনস্টেবল আমিরুলের স্ত্রীর হাতে এ অনুদানের চেক তুলে দেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। এ সময় ডিএমপি কমিশনার নিহত আমিরুলের পরিবারের খোঁজ-খবর নেন। তিনি আমিরুলের পরিবারের ভবিষ্যৎ ব্যয়ভার নির্বাহে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এর আগে ডিএমপি কমিশনারের বদান্যতা ও আন্তরিক চেষ্টায় নিহত পুলিশ কনস্টেবল মো. আমিরুল ইসলামের মৃত্যুর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তার পরিবারের হাতে পেনশনের চেক ও আনুতোষিক (গ্র্যাচুইটি) তুলে দেয়া হয়।

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
এক ক্লিকে বিভাগের খবর