জোট-মহাজোটের প্রতি আস্থা নেই জাতীয় পার্টির- চুন্নু
আওয়ামী লীগের সঙ্গে বারবার আলোচনার প্রধান বিষয় আসন বণ্টন নয়, নির্বাচন সুষ্ঠু করা- এই দাবি করেও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু স্বীকার করেছেন, কিছু আসনে কিছু সংসদ সদস্যকে জিতিয়ে আনতে সমঝোতার কথাও আছে।
তবে একাধিক সাংবাদিকের নানা প্রশ্নেও এই আলোচনার ফলাফল এখনই প্রকাশ না করে তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক কৌশলের সব কিছু কেউ বলে দেয় না।
ভবিষ্যতে প্রকাশও হবে, এমন ইঙ্গিত দিয়ে চুন্নু আবার প্রেমের প্রথম চিঠির উপমাও টেনেছেন। বলেছেন, এই চিঠির কথা কেউ বাবা-মাকে বলে না। কিন্তু বিয়ের প্রসঙ্গ এলে তখন সম্পর্কের কথা বলতেই হয়।
আগামী ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আসন সমঝোতার জন্য একটি দিন বাকি থাকতে শনিবার বনানীর দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব।
গত তিনটি নির্বাচনের মধ্যে দুটিতে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি জোট করলেও বিএনপির বর্জনে ২০১৪ সালে জোট না করে আসন সমঝোতা করেছে। এবারও নির্বাচনে আসেনি বিএনপি। এবারও হয়নি মহাজোট।
তবে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ তিনটি বৈঠকে বসেছে, সেসব বৈঠকের আলোচনায় আসন সমঝোতা নিয়ে কী কথা, তা প্রকাশ করা হয়নি এখনও।
সবশেষ শুক্রবার রাতের বৈঠকের পর বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে এসেছে বর্তমানে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য আছেন, এমন ২৩টি আসনে নৌকা প্রতীক সরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে জাতীয় পার্টি চেয়েছে গতবারের ছাড় দেওয়া ২৬ আসন।
গণমাধ্যমকর্মীরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটি প্রশ্নই বারবার সামনে আনেন, সেটা হলো জাতীয় পার্টি আসলে কয়টা আসনে ছাড় চায় আওয়ামী লীগের কাছে। কিন্তু প্রতিবারই কৌশলী জবাব দিয়ে এগিয়ে যান চুন্নু।
আপনারা নাকি তালিকা দিয়েছেন আওয়ামী লীগকে?- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, দেখুন, আমার যে টেকনিক, যে কৌশল, সবগুলো কি সব আমরা প্রকাশ করব? এটা কি কেউ করে? কেউ করে না। লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেমের চিঠি লিখব, এটা কি বাপ মাকে বলা যায়? বলা যায় না। পরে যখন হয়ে যায়, তখন বলা যায়। যখন বিয়ে সাদি করি, তখন তো বলতে হয়।
প্রেমের সম্পর্ক কতটা এগিয়েছে?- জাতীয় পার্টির মহাসচিব বলেন, সম্পর্কে প্রেম হয় আবার বিরহ হয়, আবার প্রেম গভীর হয়, আবার বিরহ হয়। প্রেমের শেষ পরিণতি তো বিয়ে। এই প্রেমে নায়ক নাকি নায়িকার চরিত্রে আছে জাতীয় পার্টি?
চুন্নু বলেন, শুনুন, সবাই কিন্তু নায়ক হতে চায়। আমিও কিন্তু মনে মনে ভাবি, যদি সালমান (সালমান খান) হতে পারতাম বোম্বের (মুম্বাই)! বিয়ের আগে আমিও মনে করছি, আরে সবচেয়ে সুন্দর একটা মেয়েকে যদি আমি বিয়ে করতে পারতাম!
এবার কি রাজনীতিতে নায়ক হতে চান? জাতীয় পার্টির নেতার জবাব, আপনারা সাংবাদিক, আপনি কি চান না নামকরা সাংবাদিক আবদুস সালাম খান হবেন? আপনি কি চান না আপনি গাফফার চৌধুরী হবেন? অবশ্যই চান। প্রত্যেকের পেশায় লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য আকাঙ্ক্ষা থাকে। আমার আশা ছিল, আমি একদিন হাইকোর্টের বিচারক হবো। হয়ে গেলাম রাজনীতিবিদ। আল্লাহ হয়ত সবার চাওয়াকে একভাবে না দিয়ে অন্যভাবে দেয়।
এর আগে চুন্নু বলেন, তারা সব আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে লড়াই করতে চান। সেই প্রসঙ্গ টেনে একজন গণমাধ্যমকর্মী জানতে চান, জাতীয় পার্টি সব আসনে লড়াই করার ক্ষমতা রাখে কি না।
জবাব জাপা মহাসচিব বলেন, যদি নির্বাচনটা হয়, ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে আসার আস্থা সৃষ্টি হয়, তাহলে নীরবে নিভৃতে ভোট বিপ্লব হয়ে যেতে পারে। বেশি লাগে না ১৫১টা পেলেই হয়, সরকার গঠনের জন্য এই আসনের প্রয়োজনীয়তা এভাবেই তুলে ধরেন তিনি।
১৫১টি কি পাবেন? চুন্নু বলেন, বললাম না, বিয়ের আগে চিন্তা করেছিলাম বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকে বিয়ে করব। হয়ত সবচেয়ে সুন্দরী না, তবে কাছাকাছি বিয়ে করতে পারছি। আশা তো করি। আশা ফুলফিল অনেক সময় হয়, অনেক সময় হয় না। আশার দোলাচালেই তো আমাদের জীবন চলছে।
জাতীয় পার্টির আসনে আওয়ামী লীগ প্রতীক প্রত্যাহার করবে কি না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, কারো প্রত্যাহার, কোনো মার্কা প্রত্যাহারে আমাদের কৌশল আছে, এটা আমরা এখনও বলতে চাই না।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা নিয়ে চুন্নু আবার মাঝে একবার বলেন, নির্বাচনের কৌশল হিসেবে কিছু বিষয় আছে, সেটা আজ আমরা বলব না, কাল বলতে পারি।
আগামীকাল কী ধরনের ঘোষণা আসছে?- সংবাদ সম্মেলনের একেবারে শেষ দিকে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, এই যে আলাপ আলোচনা… এসমস্ত বিষয়ে কালকেও কথা বলব আপনাদের সঙ্গে।
অন্য এক প্রশ্নে জাতীয় পার্টির মহাসচিব জানান, তাদের ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর কোনো আশঙ্কা নেই। জানান, নির্বাচন থেকে উঠে যাওয়ার জন্য তাকেও হুমকি দেওয়া হয়েছে।
চুন্নু বলেন, আমরা নির্বাচন করতে এসেছি। নির্বাচন থেকে চলে যাওয়ার জন্য আসি নাই। আর যদি বলেন যে চাপ, কৌশল প্রয়োগ, এসব বিষয়… প্রত্যেকটা দল তার নিজস্ব প্রয়োজনে যে কোনো টেকনিকে একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বললে প্রত্যেকে নিজস্ব সুবিধাটা পেতে চায়। সেটা তো সবার বেলায়ই ঠিক।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে কারা হুমকি দিয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি জানি না। তবে হুমকি আমার ফোনেও… একটা না বহু আছে। বাট আউ ডেন্ট কেয়ার। অনেক হুমকি এখানেও আছে, মেরে ফেলবে, এই করবে, সেই করবে। বাট আই ডোন্ট ব্রাদার। আমি কোনো জিডি করারও প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। নির্বাচনে যাব, এটা আমার রাজনীতি। আমি নির্বাচন ফেইস করব। বাংলাদেশের নাগরিক আমি, এই দেশে যুদ্ধ করেছি, কারো ভয়ে এই দেশে অন্তত আমি ভীত না।
কেন হুমকি দেওয়া হচ্ছে- এই প্রশ্নে চুন্নু বলেন, নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার জন্য, নির্বাচন করার জন্য না।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকে কতটা আসনের বিষয়ে সমঝোতায় আসতে পেরেছেন?- এই প্রশ্নে চুন্নু একবার বলেন, একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে কোনো বৈঠক করিনি। নির্বাচনটা যাতে ভালোভাবে হয়, সুষ্ঠুভাবে হয়, ভোটাররা যেন নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে আসার মতো আস্থাটা ফিরে পায়, ভোটাধিকারটা প্রয়োগ করতে পারে, এই পরিবেশটা যাতে সৃষ্টি হয়, সে জন্য সময়ে সময়ে আলোচনা করি।
আবার পরে তিনি বলেন, পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে অনেক সময় দেখা যায় স্পিকার, ডেপুটি স্পিকারের আসনে অনেকে নির্বাচন করেন না। … অনেক বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান যারা, তাদেরকে অনেক সময় ছাড় দেওয়া হয়। চরম বিরোধী দল থাকলেও ছাড়ের প্রশ্ন আসে। ঠিক এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে নির্বাচনের সার্বিক বিষয়ে এবং কোন কোন পার্লামেন্টারিয়ান আসলে ভালো হয়, তারা আসতে পারে কি না, সে বিষয়ে আলোচনা যে হয়নি, তা নয়, হয়েছে।
এরকম আসন কতগুলো নিয়ে আপনারা আলোচনা?- এই প্রশ্নে আবার পাল্টে যায় চুন্নুর জবাব। তিনি তখন বলেন, আমরা এ রকম নির্দিষ্ট কোনো আসন নিয়ে আলোচনা করি নাই। আমরা মূলত নির্বাচনটা সুষ্ঠু যাতে হয়, সেটির ওপর তাগিদ বা জোর দিয়েছি।
আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষ থেকে আসন সমঝোতা নিয়ে গণমাধ্যমে যে বক্তব্য এসেছে, সেটি তুলে ধরলে জাতীয় পার্টি নেতা বলেন, যিনি বলেছেন, এটা তার বক্তব্য। আমার বক্তব্য হলো, আমরা নির্বাচন বিষয়ে কথা বলেছি। এটা ঠিক, প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলের একটা কৌশল আছে, সব কৌশল তো আমরা অবশ্যই প্রকাশ করব না।
আরেক প্রশ্নে চুন্নু আবার বলেন, আমরা নির্বাচনে এসেছি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ফাইট করার জন্য। সেটা প্রত্যেকটা সিটে। আমরা নির্বাচন করব, একটা সিটেও আমরা প্রত্যাহার করব না। নির্বাচন করলে সব সিটেই করব।
কৌশলগত জোট নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির নেতা বলেন, কৌশল নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কোনো জোট-মহাজোট ইত্যাদির কোনো সুযোগ নেই। সেটাতে আমাদের আস্থাও নেই, বিশ্বাসও নেই।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে এই আলোচনা ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পরে এমনকি ৭ জানুয়ারি ভোটের আগ পর্যন্ত হবে জানিয়ে চুন্নু বলন, আমরা দৃষ্টান্ত রাখতে চাই, নির্বাচনে আমরা প্রতিযোগিতা করব। কিন্তু নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার জন্য দুই দলই প্রয়োজনে মাঝেমাঝে বসব।