বঙ্গবন্ধুর বন্দিজীবনের শেষ দিনগুলি
পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধু মুজিবের দিনগুলো কেমন ছিল? এতদ্বিষয়ে আমাদের মননের দীনতা এতোটাই যে, অদ্যাবধি জাতির জনকের জীবন সম্পর্কে সামগ্রিকতায় নিবিড় কোন গবেষণা হয়নি। দায়সারাভাবে করা কিছু সাক্ষাৎকার ও ছেঁদো গবেষণা থেকে যতদূর জানা যায় তা নিতান্তই অপ্রতুল।
পাকিস্তানের লায়ালপুরের মিয়ানওয়ালী কারাগারে ৯ মাস ১৪ দিনের বন্দিজীবন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারের উপরে ভিত্তি করে পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত লেখক-সাংবাদিক রবার্ট পেইন তাঁর ‘দি টর্চার্ড অ্যান্ড দি ড্যামড’ (গ্রন্থটি সংঘ প্রকাশন থেকে ‘নির্যাতিত ও অভিশপ্ত’ শিরোনামে অনূদিত হয়েছে) গ্রন্থে কিছু তথ্য লিপিবিদ্ধ করেছেন।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী গণযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরের ১০ দিন পর ২৬ ডিসেম্বর রাতে মুজিবকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার ঘটনার যে বিবরণ বইটিতে আছে তা হুবহু তুলে দিচ্ছি। মিয়ানওয়ালী কারাগারের প্রিজন গভর্নর জনাব হাবীব আলীকে উদ্ধৃত করে রবার্ট পেইন লিখেছেন,-
“কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পাবার পরপরই একটা ট্রাক নিয়ে মিয়ানওয়ালী কারাগারের দিকে যাই। কারা ফটক খুলে তার সেলের কাছে গিয়ে দেখি তিনি একটা কম্বল জড়িয়ে বিছানার উপর ঢুলছেন। এমন সময় সেখানে যারা কয়েদী ছিল তারা মুজিবকে ফিসফিস করে বলছিল যে, ওরা এসেছে। মুজিবও ফিসফিসিয়ে বললেন যে, শেষ পর্যন্ত আমি মাথা নত করবো না। তার আগে মিয়ানওয়ালী কারাগারেই সেলের মধ্যে একটা কবর খোড়া হয়েছিল। মুজিব যখন জিজ্ঞেস করেছিল, এটা কী? তখন তাঁকে বলেছিলাম যে, যুদ্ধ চলছে এটা বাংকার। শেল্টার নেবার জন্য। আসলে ছিল কবর। তখন মুজিবকে একজন কয়েদী বলছিল যে, আসলে এটা কবর। আপনি যদি আজ বের হন আপনাকে মেরে এখানে কবর দেওয়া হবে। তখন মুজিব আমাকে বলেছিল, কবরকে আমি ভয় পাই না। আমি তো জানি ওরা আমাকে ফাঁসী দেবে। কিন্তু আমি জানি আমার বাংলাদেশ একদিন স্বাধীনত হবে। এবং আমি এও জানি, বাংলার দামাল ছেলেরা হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে। সেই বাঙালী জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। তিনি সেদিন মিনতি করে বলেছিলেন, আমাকে হত্যা করে এই কবরে না, এই লাশটি আমার বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও। যে বাংলার আলো-বাতাসে আমি বর্ধিত হয়েছি- সেই বাংলার মাটিতে আমি চির-নিদ্রায় শায়িত থাকতে চাই।
যাহোক, ঐদিন ২৬ তারিখে আমি ট্রাকে করে মুজিবকে নেওয়ার জন্য মিয়ানওয়ালী কারাগারে আসি। কারণ ইতোমধ্যে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন।
ক্ষমতা হস্তান্তরকালে ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কাছে প্রার্থনা করেছিল যে,’ আমার ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে শেখ মুজিবকে হত্যা করার অনুমতি দাও। আমার জীবনে যদি কোন ভুল করে থাকি তাহলে শেখ মুজিবকে ফাঁসী কাষ্ঠে না ঝুলানো।’
তখন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো আমার নিকট এই মর্মে জরুরী বার্তা প্রেরণ করেন যে, ‘শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে দ্রুত নিরাপদ কোন স্থানে সরিয়ে ফেলা হোক।’
তখন আমি মুজিবকে মিয়ানওয়ালী কারাগার থেকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে ট্রাক নিয়ে কারা ফটকে আসি এবং সেলের মধ্যে গিয়ে শেখ মুজিবকে আমার সাথে যেতে অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি আমাকে বাধা দেন।
তখন আমি তাঁকে বলি, ‘শেখ, আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধু। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমি আপনাকে এখান থেকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে এসেছি। কারণ, এখানে কমান্ডো আসতে পারে। তারা আপনাকে হত্যা করবে। আমার উপর আপনি আস্থা রাখুন।’
তারপর মুজিবকে ট্রাকে তুলে, ট্রাকের মধ্যে লুকিয়ে, আমার চশমা ব্যারাজ নামক বাড়ীতে নিয়ে যাই। সেখানে গিয়েই তিনি একটা টেলিফোন করতে চান। মুজিব আমাকে বলেছিলেন, আমি কী আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে পারি। তখন আমি তাকে বলেছিলাম, না, আমার একমাত্র কাজ হলো আপনার জীবন রক্ষা করা। আপনি টেলিফোন করতে পারবেন না। তখন তিনি বললেন, আমি কী খবরের কাগজ পড়তে পারি। আমার উত্তর ছিল, না। এরপর বললেন, আমি কী এক কাপ চা পেতে পারি। তখন তাঁকে এক কাপ চা দেওয়া হয়। আমার বাড়ীতে তিনি দুই দিন থাকেন।
দিন দুই পরে মুজিবকে নিয়ে যাই শাহুল্যা নামক স্থানে। যেটা একসময় বৃটিশ সেনাবাহিনীর রেস্ট হাউস ছিল। পিন্ডির থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে এই শাহুল্যাতে প্রেসিডেন্ট ভুট্টো মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। ভুট্টো যখন আসলেন তখন একজন কর্নেল এসে মুজিবকে বলছিল, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসবে।
তারপরে সেখানে ভুট্টো আসলেন এবং মুজিবকে সালাম দিয়ে বললেন যে, ‘নাউ আই অ্যাম দ্য প্রেসিডেন্ট অব পাকিস্তান অ্যান্ড চীফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর।’
ঐ অবস্থায় মুজিব হেসে দিলেন।
তখন ভুট্টো জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি হাসছেন কেন?’
তখন মুজিব বললেন, ‘আমি বুঝতে পারি একজন প্রেসিডেন্ট সিভিলিয়ান হতে পারে। কিন্তু আমি অবাক হই যখন শুনি যে, একজন সিভিলিয়ান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক।’
তখন ভুট্টো বলেছিলেন, ‘দ্যাট ইজ পসিবল ইন পাকিস্তান।’
তারপরই মুজিবের দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল যে, ‘ভুট্টো, টেল মি ফার্স্ট, হোয়েদার আই অ্যাম এ ফ্রি ম্যান অর প্রিজনার।’
তখন ভুট্টো উত্তর দিয়েছিলেন, ‘নাইদার ইউ আর এ প্রিজনার, নর ইউ আর এ ফ্রিম্যান।’
তখন মুজিব পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইন দ্যাট কেইস আই উইল নট টক টু ইউ।’
তখন জুলফিকার আলী ভুট্টো বলতে বাধ্য হলেন যে, ‘ইউ আর এ ফ্রিম্যান।’
এরপর মুজিব প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। ভুট্টো অনেক রকমের প্রস্তাব দিলেন। কীভাবে একটা কনফেডারেশন করা যায়, কীভাবে একসাথে থাকা যায়, ইত্যাদি।
কিন্তু মুজিব কোন কথাই বললেন না। চুপ করে থেকে শুধু বললেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আমার প্রিয় সহকর্মীদের সাথে কথা বলতে না পারবো, ততক্ষণ আমার পক্ষে কিছুই বলা সম্ভবপর নয়।’
এরপর মুজিবকে একটা যৌথ ইশতেহার দেওয়া হয়েছিল স্বাক্ষর করার জন্য। মুজিব সেটাও প্রত্যাখ্যান করলেন।
পরিশেষে শেখ মুজিব বললেন, ‘আমি কী এখন দেশে যেতে পারি?’
ভুট্টো বললেন, ‘হ্যাঁ, যেতে পারেন। কিন্তু কীভাবে যাবেন? পাকিস্তানের পিআইএ ভারতের উপর দিয়ে যায় না।’
তখন মুজিব বললেন, ‘সেক্ষেত্রে আমি লন্ডন হয়ে যাবো’।”