রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয় -প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন‘’ রক্তের অক্ষরে আমরা যে ভাষার অধিকার আদায় করেছি সেটা এখন সারা বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে”।
আজ বৃহস্পতিবার (০১ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর বাংলা একাডেমিতে মাসব্যাপী বই মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন,আমরা বাঙ্গালি, বাংলা ভাষায় কথা বলি, মায়ের ভাষায় কথা বলি। এই অধিকারটা আমরা পেয়েছি, সেটাও আমাদের রক্ত দিয়েই অর্জন করতে হয়েছে।
বাংলা একাডেমি আমাদের অনেক আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার । বাংলা একাডেমি ২১শে বই মেলা আয়োজন করেছে।এই বই মেলা আমাদের প্রাণের মেলা। এই বই মেলা আজকে শুধু আমাদের নিজের না , আমাদের যেমন ২১ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে এই বই মেলাও কিন্তু বিশ্ব স্বীকৃতি পেয়েছে ।এটাই হচ্ছে আমাদের বড় অর্জন ।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের মাতৃভাষা বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। সেই প্রাচীনকালের চর্যাপদ থেকে শুরু করে আমাদের বিভিন্ন যে সাহিত্য, তার চর্চা এবং ভাষার বিবর্তন হয়েছে। সাথে সাথে যে কোন সাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজের অনেক চিত্র ,অনেক ইতিহাস ,অনেক না বলা কথা জানা যায়। আর এটাই হচ্ছে সব থেকে বড় জিনিস।
বই মেলা নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান বলেন,আমি শুধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই যে এখানে এসেছি তা নয়। সেই স্কুল জীবন থেকেই এখানে ছুটে আসতাম। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আমি পড়তাম তখন আসতাম। এই প্রাঙ্গণে এসে বিশেষ করে বাংলা একাডেমির লাইব্রেরিটাই আমি সব থেকে বেশি ব্যবহার করতাম। এটা আমাদের, আমি আর আমার বান্ধবী বেবি মওদুদ। খুব প্রিয় লাইব্রেরি ছিল আমাদের। আমি ছাত্রলীগ করতাম আর বেবী ছিল ছাত্র ইউনিয়নের কিন্তু আমাদের দুজনের অত্যান্ত গভীর বন্ধুত্ব ছিল। টিএসসিতে এক প্লেট ভাত কিনে ভাগ করে খেয়ে আমরা বাংলা একাডেমিতে এসে এই বটতলা অথবা পুকুরপাড়ে বসে পড়াশোনা করতাম।এটা আমার অনেক স্মৃতি বিজড়িত জায়গা ।
বই মেলা প্রাঙ্গণের জায়গা স্বল্পতার কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, বই মেলার এখানে জায়গা ছোট দেখে এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও হয়, সেখানে বইয়ের স্টলগুলি তৈরি করা হচ্ছে । তবে আমি মনে করছি যে এখানে এই জায়গাটা একটু ছোট হয়ে যাচ্ছে আমাদের। কারণ এতো মানুষ আসতে চায় জায়গা দেয়া যায়না । কাজেই কিভাবে একটু বড় জায়গায় আমাদের অনুষ্ঠানটা করা যায় সেটা আমাদের একটু চিন্তা ভাবনা করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। তারপরও আমি বলবো যে “বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এটার একটা আলাদা ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে” ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের এই মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারও কেড়ে নিতে চেয়েছিল পাকিস্থানি শাসকরা । প্রথমেই শুরু করল আরবি হরফে বাংলা লেখা, এর পরবর্তীতে এসে আবার রোমান হরফে বাংলা লেখা । তারও প্রতিবাদ কিন্তু এদেশের সকলে করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীটা পড়ে দেখলে সেখানে কিন্তু ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তার অনেক তথ্য পাওয়া যায়।
রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, সব থেকে বড় কথা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে পাকিস্থানী গোয়েন্দা সংস্থা সব সময় কিন্তু তার পিছনে লেগে থাকতো। সেই আটচল্লিশ সালে যখন প্রথম রাষ্ট্রভাষা বাংলার মর্যাদা অর্জনের জন্য “ভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করা হয় এবং আন্দোলন শুরু হয় সেই সময় থেকে গোয়েন্দা সংস্থা রিপোর্ট লেখা শুরু করে । সেই রিপোর্টগুলো আমি সংগ্রহ করি এবং সেটা আমি প্রকাশও করেছি । ১৩ খণ্ড প্রকাশিত হয়ে গেছে শেষ খণ্ডটা ১৪ এটা এখন প্রেসে আছে প্রকাশিত হবে। প্রায় ৪৫ হাজারের উপর পাতা ছিল। আমি সবগুলি সংগ্রহ করি। ৯৬ সালে যখন সরকারে আসি তখন সেগুলি সংগ্রহ করি গোয়েন্দা সংস্থার অফিস থেকে। আমি এবং বেবি মওদুদ প্রায় বিশটা বছর এটার উপর কাজ করেছি । এবং পরবর্তীতে আমি দ্বিতীয়বার যখন সরকারে আসি তখন থেকে এটা প্রকাশ করা শুরু করেছি । সিক্রেট ডমুমেন্টস অফ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন দ্যা ফাদার অফ দ্যা নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফাইলের উপরে লেখা ছিল সিক্রেট ডকুমেন্টস অফ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অল শেখ মুজিবুর রহমান । কাজেই এই নামেই আমি প্রকাশ করেছি, সেখানে অনেক ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যাবে । ১৯৪৮ সালে ৪ঠা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্ট লীগের অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটির পক্ষ থেকে বাংলা ভাষাকে পাকিস্থানের রাষ্ট্র ভাষা করার একটি সম্মিলিত লিফলেট স্বাক্ষর করেন। ১১ মার্চ “ভাষা দাবী “দিবসে ধর্মঘট চলাকালে তিনি গ্রেফতার হন। কারণ তখনই সিদ্ধান্ত হয় শুধু ছাত্র সংগঠন থেকে তমদ্দুন মজলিস এবং অন্যান্য প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন এবং তিনি জানুয়ারি মাসে ৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তখন পূর্ব পাকিস্থান ছাত্রলীগ গঠন করেন । কাজেই ছাত্রলীগ তমদ্দুন মজলিস এবং অন্যান্য প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন নিয়েই এই সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় এবং ১১ মার্চ ভাষা দিবস হিসেবে ধর্মঘট পালিত হয় , সেই ধর্মঘট থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ আরও অনেকেই গ্রেফতার হন। ১৫ মার্চ মুক্তি পান। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমতলা আসলে এটা তখন ছিল এখন আমাদের যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ওটার ইমার্জেন্সির গেটটা যেখানে সেখানে ছিল ঐ আমতলাটা । সেখানে যে ১৬ মার্চ যে সভা হয় সেই সভার সভাপতিত্ব করেছিলেন ছাত্রনেত্রা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। সেখানেও লাঠি চার্জ ,গুলি হয়। আর সিক্রেট ডকুমেন্টস অফ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অফ দ্যা ফাদার অফ দ্যা নেশন বইতে অনেক তথ্য সেখানে আছে। বিভিন্ন জেলা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করার সাথে সাথে গোপালগঞ্জ ,ফরিদপুর মিছিল হয় । সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্ররা মিছিল করে প্রতিবাদ জানায়। সেই তথ্যগুলি আছে ৷ সেখানে একটা নোটে লেখা রয়েছে ফরিদপুরের এসপি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে একটা নোট পাঠাচ্ছেন, সেখানে বলা হয়,” শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ৪৮ সালে ১৬ মার্চ গোপালগঞ্জে সর্বাত্মক হরতাল ডাকা হয়। বিকেলে এসএন একাডেমি এবং এমএন ইনস্টিটিউটের চারশ ছাত্র শহরে বিক্ষোভ মিছিল করে, “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, নাজিমউদ্দিন নিপাত যাক”, মুজিবকে মুক্তি দিতে দাও , এই স্লোগান দিয়ে তারা রাস্তা প্রদক্ষিণ করেন”তৃতীয়বার যখন গ্রেফতার হন তখন আর ছাড়েনি । তখন চিকিৎসার জন্য মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসে সেই সময় সংগ্রাম পরিষদ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় এবং এটা কিন্তু সিক্রেট ডকুমেন্টসেও এ কথাটা উল্লেখ আছে, এবং মুজিব একটি রাষ্ট্রের রূপকার এই সিনেমাটাও যদি আপনারা দেখেন সেখানে কিন্তু এই তথ্যগুলি সুন্দরভাবে দেয়া রয়েছে ।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, আসলে আমরা ছাত্র জীবন থেকে যেটা দেখেছি এক সময় দেখা গেলো আয়ুব খান, মোনায়েম খান তখন গর্ভনর তিনি এলাম জারি করলেন যে রবীন্দ্রনাথ পড়া যাবেনা, রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া যাবেনা। রবীন্দ্র সংগীত ব্যান্ড । আমি অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার ছাত্রী ছিলাম , আমাদের সব থেকে বেশি আতে ঘা লাগলো। এর আগে কলেজে থাকতেও ল্যাটিন ভাষায় বাংলা লেখার প্রস্তাব সেটাও কিন্তু স্কুল জীবন থেকে স্কুলের দেয়াল টপকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা মিটিং এ আমরা এসেছি । তার প্রতিবাদ জানাতে তখন এই ছাত্ররাই কিন্তু সেটা বন্ধ করেছিল এরপর আসলো রবীন্দ্রনাথ পড়া যাবেনা, মোনায়েম খান , আমাদের বাংলা বিভাগের যিনি প্রধান ছিলেন প্রফেসর হাই সাহেব উনাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। ডেকে নিয়ে খুব ধমক , কেন সবাই প্রতিবাদ করছে,রবীন্দ্র সঙ্গীত,রবীন্দ্র সঙ্গীত কি? তা আপনারা দু চারখানা রবীন্দ্র সঙ্গীত লিখে ফেলতে পারেন না? এই ছিল মোনায়েম খানের কথা । হাই সাহেব কিন্তু খুব ভদ্র একজন মানুষ ,তিনি খুব স্বল্পভাষী ছিলেন, কম কথা বলতেন, খুব ধীরে ধীরে তিনি কথা বলতেন , খুব সুন্দরভাবে কথা বলতেন ,ওনার ভাষণটা ছিল খুব সুন্দর ।
উনি বললেন,স্যার আমরা তো লিখতে পারি কিন্তু আমি যদি লেখি সেটা তো রবীন্দ্র সঙ্গীত হবেনা, সেটা হবে হাই সঙ্গীত । আমরা কেমন রাষ্ট্রের অধিনে ছিলাম একবার চিন্তা করে দেখেন। সেখানেও আমাদের সংগ্রাম করতে হয় ।
তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি । আপনারা জানেন যে স্বাধীনতার পর যখন জাতিসংঘ আমাদের স্বীকৃতি দিলো, ৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেখানে ভাষণ দিতে যান। এবং তিনি কিন্তু বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়েছিলেন। বাংলা ভাষায় ভাষণ অর্থাৎ বাংলাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। রবী ঠাকুর যেমন তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ভাষাকে নিয়ে এসেছিলেন । আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক,সামাজিক অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রামের যে বক্তব্য সেটাই তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন বাংলা ভাষায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ।আমি আমার বাবার পথ অনুসরণ করে এ পর্যন্ত যতবার ভাষণ দিয়েছি,সেটাও কম না তাও প্রায় ১৯/২০ বার হবে আমি কিন্তু প্রতিবার বাংলায় ভাষণ দিই ।
কারণ যখন এই কথাটা মনে আসে তখন ঐ কথাটাই মনে পড়ে, মোদের গরব মোদের আশা , আ মরি বাংলা ভাষা । কী মধুর আমাদের ভাষা ।
বই প্রকাশকের উদ্দেশ্য করে শেখ হাসিনা বলেন, এখন বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগ । বই প্রকাশ এটা অবশ্যই থাকবে এটা যাবেনা, বই হাতে নিয়ে পাতা উলটে পড়ার মধ্যে আলাদা একটা আনন্দ আছে । তবে আজকাল ছেলেমেয়েরা ট্যাবে করে বই পড়ে, অথবা ল্যাপটপে পড়ে । যদিও আমরা ওতে খুব আনন্দ পাইনা কিন্তু তারপরও আমাদের ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি সব কিছু নিয়ে যেতে হলে আমাদের যুগের সঙ্গে তাল মিলে চলা উচিৎ । প্রকাশকদের কাগজে প্রকাশক হলে হবেনা, ডিজিটাল প্রকাশক হতে হবে ।