চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করলো পিবিআই
টাঙ্গাইলের চাঞ্চল্যকর মুকুল (২৪) হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন। গত ১৭ ফ্রেবুয়ারি ২০২৪ তারিখ রাত্রে টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও ঢাকা জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে ঘটনার সাথে জড়িত আসামী ১। মোঃ সোহেল (৩৪) ও ২। শ্রী পরেশ চন্দ্র শীল ওরফে নাজমুল হোসেন (৪০) দ্বয়কে গ্রেফতার করেছে পিবিআই, টাঙ্গাইল জেলা।
গত ইং ১২/০২/২০২৪ তারিখ সকাল অনুমান ০৯.০০ ঘটিকায় টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী থানাধীন পারখী সাকিনস্থ মনির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের উত্তর পার্শ্বে বগা বিলে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির লাশ মাটি চাপা দেওয়া অবস্থায় আছে মর্মে সংবাদ পাওয়া যায়।
সংবাদ পেয়ে সিরাজ আমীন, পুলিশ সুপার, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) টাঙ্গাইল জেলার নির্দেশে পুলিশ পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান আনসারীর নেতৃত্বে একটি চৌকস টিম দ্রুততার সাথে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে কালিহাতী থানা পুলিশকে আইনি সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহপূর্বক ছায়া তদন্ত শুরু করে। পিবিআই টাঙ্গাইল টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে মুকুলের স্ত্রী লিমা আক্তারের সনাক্তমতে জানতে পারে যে, অজ্ঞাতনামা ডিসিষ্টের নাম মুকুল (২৪), পিতা মোঃ হানিফা, সাং—পারখী, থানা—কালিহাতী, জেলা—টাঙ্গাইল। সে সখিপুর থানাধীন ইন্দারজানি এলাকায় তার শ্বশুড় বাড়িতে থাকত এবং সখিপুর থানাধীন খুংগারচালা বাজারে ইলেকট্রিক সামগ্রীর দোকান দিয়ে ব্যবসা করত। গত ইং ২৭/০১/২০২৪ তারিখ বিকেল অনুমান ০৫.০০ ঘটিকায় ডিসিষ্ট খুংগারচালা বাজারে তার দোকান বন্ধ করে বের হয়ে যায়। পরবর্তীতে সে তার শ্বশুড় বাড়িতে না ফেরায় ইং ২৭/০১/২০২৪ তারিখ রাত অনুমান ০৯.০০ ঘটিকায় তার শ্বশুড় ইসমাইল মোবাইল নং—০১৩২৬—৪৮৫৬৭৬ থেকে ডিসিষ্টের মোবাইল নং—০১৭০৪—৫৯০৯১২ এ ফোন করলে মুকুল জানায় সে কালিহাতী আছে, রাতে বাড়ি ফিরবে না। ইং ২৮/০১/২০২৪ তারিখ সকাল অনুমান ০৮.০০ ঘটিকায় ডিসিষ্টের শ্বশুড় ডিসিষ্টের মোবাইলে ফোন দিয়ে বন্ধ পায়।
তারপর হতে মুকুলের খোঁজাখুঁজি করতে থাকাবস্থায় ইং ১২/০২/২০২৪ তারিখ ভোর অনুমান ০৫.০০ ঘটিকায় পারখী চকপাড়া গ্রামের বাসিন্দা চাঁন মিয়া ধান ক্ষেতে পানি দেওয়ার সময় ধান ক্ষেতের আইলে কাঁদা মাটিতে পুঁতে রাখা লাশের মাটির উপরের অংশে বের হয়ে থাকা হাত ও মাথার খুলি দেখে এলাকার লোকজনদের সংবাদ দেয়। পরে কালিহাতী থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে কাঁদার মধ্য হতে অনুমান ১৫/১৬ দিনের পঁচাগলা মৃতদেহ উত্তোলন করে মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতপূর্বক লাশ ময়না তদন্তের জন্য টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালে প্রেরন করেন। ডিসিস্টের স্ত্রী লিমা আক্তার মুকুলের গায়ে থাকা গেঞ্জি, পরিহিত প্যান্ট ও বেল্ট দেখে মুকুলকে সনাক্ত করেন। উক্ত ঘটনায় মুকুলের স্ত্রী লিমা আক্তার (১৯) বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামী/আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করলে কালিহাতী থানার মামলা নং—১০, তারিখ ১৪/০২/২০২৪ ইং, ধারা—৩০২/২০১/৩৪ দন্ডবিধি রুজু করা হয়। উক্ত হত্যা মামলাটি পিবিআই এর সিডিউলভূক্ত মামলা হওয়ায় পিবিআই হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকার মাধ্যমে গত ইং ১৫/০২/২০২৪ তারিখ পিবিআই টাঙ্গাইল জেলা মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে। পিবিআই টাঙ্গাইল জেলা মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে পুলিশ সুপার, পিবিআই, টাঙ্গাইল জেলা মহোদয়ের সার্বক্ষণিক নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে তথ্য প্রযুক্তি এবং বিভিন্ন উৎস হতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও ঢাকা জেলার বিভিন্ন স্থানে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করে প্রথাগত তদন্তের পাশাপাশি তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘটনায় জড়িত ও ঘটনার পর হতে পলাতক আসামীদের অবস্থান নির্ণয় করে সন্ধিগ্ধ আসামী মুকুলের বড় ভাই (১) মোঃ সোহেল (৩৪), পিতা—মোঃ হানিফা, সাং—পারখী, থানা—কালিহাতী, জেলা—টাঙ্গাইল ও ২। শ্রী পরেশ চন্দ্র শীল ওরফে নাজমুল হোসেন (৪০), পিতা—মৃত রমনী কান্ত শীল, মাতা—জোৎস্না রাণী শীল, সাং—উত্তর দগরবাড়ী, থানা—চিরির বন্দর, জেলা—দিনাজপুরদ্বয়কে ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানা এলাকা হতে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার করার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সন্দিগ্ধ আসামীদ্বয় অত্র মামলার ঘটনার সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকার করে।
অত্র মামলার খুনের ঘটনায় ও মুকুলের মৃতদেহ পুঁতে রাখার কাজে ব্যবহৃত কোদাল কালিহাতী থানাধীন পারখী সাকিনস্থ জনৈক আঃ লতিফ বুচা’র বাড়ীর পশ্চিম পার্শ্বে তার পুকুর হতে এবং মুকুলের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন কালিহাতী টু বড় চওনা পাকা রাস্তার দক্ষিন পার্শ্বে জনৈক রফিক মাস্টারের ডোবা জমি হতে গ্রেফতারকৃত সোহেল এর দেখানো মতে উদ্ধারপূর্বক বিধি মেতাবেক জব্দ করা হয়। আমাদের জিজ্ঞাসাবাদে উল্লিখিত আসামীদ্বয় অত্র মামলার ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে এবং ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে। সন্দিগ্ধ আসামী মোঃ সোহেল (৩৪) ঢাকা জেলার আশুলিয়া ও শ্রী পরেশ চন্দ্র শীল ওরফে নাজমুল হোসেন (৪০) গাজীপুর মেট্রোপলিটন এলাকার কোনাবাড়ী এলাকায় বসবাস করতো। মুকুল আসামী সোহেল এর আপন ছোট ভাই। জিজ্ঞাসাবাদে আসামী সোহেল জানায় মুকুল মাদক দ্রব্য সেবন সহ ক্রয় বিক্রয় করা, বিভিন্ন ব্যাক্তি এবং এনজিও হতে ঋন গ্রহন সহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়া, ডিসিস্টের কার্যকলাপে তার বড় ভাই সোহেল বিভিন্ন ভাবে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায়, মুকুলের উপর আসামী সোহেল চরমভাবে ক্ষিপ্ত হয়। সন্দিগ্ধ আসামী সোহেল আশংকা করে যে, ডিসিস্টের ঋনের কারনে তাদের পৈত্রিক বাড়িঘর এবং জমিজমা সবকিছুই বিনষ্ট হয়ে যাবে। এ ছাড়াও সোহেল বিদেশে অবস্থান করা কালে তার ছোট ভাই মুকুল তার স্ত্রীকে বিভিন্ন অনৈতিক প্রস্তাব দেয় এবং যৌন হয়রানি করে। সোহেল দেশে চলে আসার পরেও সে তার স্ত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে। বিষয়টি সোহেলের স্ত্রী সোহেলকে জানালে সোহেল তার ছোট ভাই মুকুলকে বারবার সতর্ক করে এবং এধরনের আচরণ না করতে আনুরোধ করে। তথাপিও মুকল তার বাঁধা নিষেধ অমান্য করে তার স্ত্রীকে যৌন হয়রানি করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। মুকুলের এ ধরনের আচরণ সহ্য করতে না পেরে সোহেল অতিষ্ঠ হয়ে তাকে চিরতরে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহন পূর্বক পরিকল্পনা করতে থাকে।
সেই লক্ষ্যে সোহেল তার ঘনিষ্ট বন্ধু শ্রী পরেশ চন্দ্র শীল ওরফে নাজমুল হোসেন (৪০) এর সাথে শলাপরামর্শ করে এবং তাকে টাকার বিনিময়ে রাজী করিয়ে ডিসিস্ট মুকুলকে খুন করার চূড়ান্ত পরিকল্পনা নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী সোহেল এই মামলার ঘটনার কয়েকদিন আগে পারখী এলাকায় এসে কোন জায়গায় খুন করা যায় সেই ধরনের জায়গা নির্বাচন করে। পরে ইং ২৭/০১/২০২৪ তারিখ আসামী সোহেল (৩৪) ও শ্রী পরেশ চন্দ্র শীল ওরফে নাজমুল হোসেন (৪০) ঢাকা থেকে কালিহাতী থানাধীন হামিদপুর বাসষ্টান্ডে নেমে হামিদপুর বাজার হতে একটি কোদাল ও কোদালের আছারি ক্রয় করে পারখী যায় এবং যাওয়ার আগে টেলিফোনে ডিসিষ্ট মুকুলকে তার সাথে জরুরী কথা আছে মর্মে পারখী সাকিনস্থ মনির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে অবস্থান করতে বলে। ঐদিন রাত অনুমান ০৮.০০ ঘটিকায় আসামী সোহেল (৩৪) ও শ্রী পরেশ চন্দ্র শীল ওরফে নাজমুল হোসেন (৪০) পারখী মনির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে উপস্থিত হয়ে স্কুলের অনুমান ৩০০ গজ উত্তর দিকে সরিষা ক্ষেতে কোদাল রেখে আসে। পরে ডিসিষ্ট মুকুল স্কুল মাঠে উপস্থিত হলে তারা কৌশলে মুকুলকে স্কুল হতে অনুমান আধা কিলোমিটার উত্তর দিকে বগা বিলের মধ্যে নিয়ে যায়। পরে রাত অনুমান ২৩.০০ ঘটিকার সময় তারা মুকুলের গলায় তার পরিহিত মাফলার পেঁচিয়ে হত্যা করে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তারা দুজন বগা বিলের কাঁদার মধ্যে তাদের সাথে নিয়ে যাওয়া কোদাল দিয়ে গর্ত খুঁড়ে মুকুলকে পুঁতে রাখে এবং কোদালটি পাশের একটি পুকুরে ফেলে দেয়। পরে ঐ রাতেই তারা যে যার বাসায় চলে যায় এবং যাওয়ার সময় কালিহাতী থানাধীন রৌহা নামক স্থানের একটি খালে মুকুলের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ফেলে দেয়। আসামীদ্বয় তাদের নিজেদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ করে অজ্ঞাত স্থানে পলাতক হয়।
অ্যাডিশনাল আইজিপি, পিবিআই জনাব বনজ কুমার মজুমদার, বিপিএম (বার), পিপিএম এর তত্ত্বাবধান ও দিক নির্দেশনায় পিবিআই, টাঙ্গাইল ইউনিট ইনচার্জ পুলিশ সুপার জনাব মোহাম্মদ সিরাজ আমীন এর সার্বিক সহযোগিতায় তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (নিঃ) মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান আনসারী মামলাটির ছায়া তদন্ত শুরু করেন।