শ্রমিক লীগে শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব
-প্রকাশ্যে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অভ্যন্তরীণ কোন্দল
-দলীয় কিংবা জাতীয় কর্মসূচিতেও নেই তাদের অংশগ্রহণ
-ধীরে ধীরে অকার্যকর সংগঠনে পরিণত হচ্ছে শ্রমিক লীগ
দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামে জাতীয় শ্রমিক লীগের সোনালী অতীত-ঐতিহ্য আছে। কিন্তু বর্তমানে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নূর কুতুব আলম মান্নান ও সাধারণ সম্পাদক কে এম আজম খসরু’র অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সংগঠনটিতে দেখা দিয়েছে সাংগঠনিক স্থবিরতা। তারা একে অপরের পাশাপাশি বসা তো দূরে থাক, পারত পক্ষে কেউ কারও দিকে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন মনে করেন না। এমনকি দল কিংবা জাতীয় কর্মসূচিতেও তাদেরকে একা একা অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।
সর্বশেষ গত বছরের পহেলা ‘মে দিবস’ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত শ্রমিক সমাবেশে একই মঞ্চে তাদের যৌথ উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। যার নৈপথ্যে ছিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের দিক-নির্দেশনা। আর বাস্তবায়ন করেছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মো. রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ। এরপর থেকে শীর্ষ নেতৃত্বের কোন্দলে সংগঠনটির রাজনৈতিক গতিশীলতা যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অকার্যকর সংগঠনের দিকে ধাবিত হচ্ছে শ্রমিক লীগ। কমিটি গঠন থেকে শুরু করে সংগঠনের সর্বক্ষেত্রে শীর্ষ দুই নেতার আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় কখনো কোনো জেলা, মহানগর, কিংবা ওয়ার্ড ও থানা কমিটি ঘোষণায় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবার কখনও নতুন কমিটি ঘোষণা দিচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক। ক্রমান্বয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে শ্রমিক লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও জড়িয়ে পড়ছেন নানা অসামাজিক কার্যক্রমে।
দুই নেতার বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে শ্রমিকদের স্বার্থে এই সংগঠন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। সংগঠনটির নেতৃত্বের মাঝে নিষ্ক্রিয়তার চিত্র ফুটে উঠছে। অথচ জাতীয় শ্রমিক লীগ বাংলাদেশের একটি জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন। এটি আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের সঙ্গেও যুক্ত। ১৯৬৯ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক লীগ। রাজনৈতিক ভাবে এই সংগঠনটি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
জাতীয় শ্রমিক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নুর কুতুব আলম মান্নান সোনালী বার্তাকে বলেন, ‘গ্রুপিং আছে, শুধুমাত্র জাতীয় শ্রমিক লীগে অভ্যন্তরীণ সমস্যা তা নয়। বরং সব সংগঠনেই অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকে। কোন সংগঠনে কম আবার কোন সংগঠনে একটু বেশি। শ্রমিক লীগে শুধু অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল নয়, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতাও আছে। তারপরও সংগঠনের সাংগঠনিক অবস্থান গতিশীল রাখতে উত্তোরণের পথ খুঁজে বের করার মধ্যে দিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হাতের সব আঙুল যেমন সমান হয় না, তেমনই সংগঠনের সবাই যে ভালো কিংবা সবাই মন্দ সেটাও সঠিক নয়। ভালো-মন্দ মিলেই সংগঠনের স্বার্থে ভালোকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করছে জাতীয় শ্রমিক লীগ। সারাদেশে সংগঠনের সাংগঠনিক অবস্থা ভালো আছে। মাঝে মাঝে কিছু সমস্যা যে সৃষ্টি হয় না তা বলছি না। তবে একটি কথা পরিষ্কার সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে যে বা যারা ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে কোনো ধরনের অনিয়মে জড়ান তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে কাউকে ছাড় দেয় না জাতীয় শ্রমিক লীগ। কোনো প্রকার ছাড় দেয়া হবে না।
এদিকে, জাতীয় শ্রমিক লীগের শীর্ষ দুই নেতার সৃষ্ট কোন্দল নিরসনে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারাও দায়িত্বপ্রাপ্তদের নিয়ে বৈঠক করেছিল। কিন্তু সংকট নিরসনে তাদের বৈঠক ব্যর্থ হয়েছে বলেও সংগঠনের ভেতরে-বাইরে কথার গুঞ্জন আছে। যদিও তখন বৈঠক শেষে সংগঠনের দুই শীর্ষ নেতা গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে সাংগঠনিক কর্মকা- পরিচালনা করার কথা জানান।
কিন্তু সংগঠনের সার্বিক চিত্র দেখে মনে হয় তাদের সেই ঘোষণা কাগজে-কলমেই থমকে আছে। কেননা বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় শ্রমিক লীগে কোনো বিভেদ বা কোন্দল নেই। একইসঙ্গে সংগঠনের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সকল বিভেদ-অনৈক্য ভুলে গিয়ে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করার আহ্বান জানানো যাচ্ছে। এমনকি জাতীয় শ্রমিক লীগের ভাবমূর্তি ও সংগঠনের একতা-সম্প্রীতি বিনষ্ট হতে পারে এ ধরনের সকল কর্মকা- থেকে বিরত থাকার জন্য সংগঠনের সকল স্তরের নেতাকর্মীদের প্রতি সতর্ক নির্দেশনাও দেয়া হয়। তারপরও শ্রমিক লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্যে রুপ নিয়েছে।
কারও কারও মতে, শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনটি এখন চুপসে গেছে। অথচ শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা ও তা বাস্তবায়নে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে জাতীয় শ্রমিক লীগের গঠনতন্ত্রেও। শ্রমিকদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতি অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখার কথা থাকলেও শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত কোনো আন্দোলনে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না নেতাদের।
যদিও শ্রমিক লীগের গঠনতন্ত্রের (ড) ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, বর্তমান বাজার দরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শ্রমিক-কর্মচারী ও মেহেনতি মানুষের জীবনধারণ উপযোগী বেতন, মঞ্জুরী, ভাতা, বোনাস, চাকরির স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা, কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বীমা, বৃদ্ধ বয়সে পেনশন, দুর্ঘটনায় পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ, গ্র্যাচুইটি, মৃত্যুর পর পরিবারের একজনকে চাকরি দেওয়ার চেষ্টা করার কথা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সবশেষ ২০১৯ সালের ০৯ নভেম্বর জাতীয় শ্রমিক লীগের সম্মেলনে ফজলুল হককে সভাপতি এবং কে এম আজম খসরুকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক মন্টু মারা গেলে পদটি শূন্য হওয়ায় ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর জাতীয় শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সহ-সভাপতি মো. নূর কুতুব আলম মান্নানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। যদিও শুরু থেকেই সংগঠনের শীর্ষ এই দুই নেতার মাঝে চলে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। এরপর থেকে উভয়েই সংগঠনের স্বার্থের বাইরে নিজস্ব বলয় তৈরির রাজনীতিটাই করে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ তৃণমূল নেতাকর্মীদের।
আর শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিভক্তি সর্বশেষ প্রকাশ্যে আসে ২০২২ সালের ২২ জানুয়ারি। সে দিন শ্রমিক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির নেতৃত্বে সংগঠনের নেতাদের একটি অংশ বৈঠক করেন। সেখানে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন না।
অভিযোগ রয়েছে, সাধারণ সম্পাদককে বৈঠকের বিষয়ে জানানোও হয়নি। সেই বৈঠকে সাধারণ সম্পাদককে সরিয়ে প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদককে দায়িত্ব দেয়া হয় বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। এই খবর সংগঠনের বিভিন্ন নেতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্টও দেন। কিন্তু ২২ জানুয়ারি না জানিয়ে বৈঠক করায় এবং তাকে সরিয়ে আরেকজনকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে শুনে শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক কে এম আজম খসরু গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নুর কুতুব আলম মান্নানসহ কেন্দ্রীয় কমিটির চার জনকে বহিষ্কার করেন।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গঠনতন্ত্র ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কার হওয়া অপর তিন জন হলেন- সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খান সিরাজুল ইসলাম, বি এম জাফর ও দপ্তর সম্পাদক ফজলুল হক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় কমিটির বেশ কয়েকজন শ্রমিক নেতা সোনালী বার্তাকে বলেন, জাতীয় শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক স্বকীয়তা থাকলেও যেহেতু এটি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে, তাই সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ চাইলেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি পাশ কাটিয়ে কিছু করা যায় না। যদিও জাতীয় শ্রমিক লীগের জন্মই হয়েছিল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায়। সেই শ্রমিক লীগে যেখানে নেতৃত্বের প্রতিযোগীতা থাকার কথা সেখানে বিরাজ করছেন শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব। যা সংগঠনের সাংগঠনিক গতিশীলতার অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছে। কেবলমাত্র সংগঠনের সাংগঠনিক অভিভাবক, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া শ্রমিক লীগের ঐতিহ্য ফেরানো যাবে না।
জাতীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক কে এম আজম খসরু সোনালী বার্তাকে বলেন, শ্রমিক লীগের কার্যক্রম কারও চোখে দৃশ্যমান আবার কারও চোখে অদৃশ্যই থাকছে। জাতীয় নির্বাচনের পর পরই অন্যান্য সংগঠনের নেতারা যখন বিদেশ ভ্রমণে যাচ্ছেন, সেখানে জাতীয় শ্রমিক লীগের নেতৃত্ব দেশেই অবস্থান করছে। একইসঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজনও করে যাচ্ছে। ভাষা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সামনে আরও কর্মসূচি নির্ধারিত আছে।
সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব সাংগঠনিক কাজের অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দ্বন্দ্ব তো আছেই। তিনি (ভারপ্রাপ্ত সভাপতি) তো জাতীয় পর্যায়ের কোনো নেতা নন, সভাপতির মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে এই পদে এসেছেন। সংগঠনের রাজনীতিতে তিনি অদক্ষ এবং তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে অগ্রহণযোগ্য নেতা। তিনি নেতৃত্বে আসার পর থেকেই সংগঠনের ভেতরে-বাইরে চলছে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা, কার্যত সংগঠনের অগ্রগতি হচ্ছে না।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতিসহ সুবিধাভোগী পুরানো কিছু শ্রমিক নেতারা মেনে নিতে পাচ্ছেন না। তবে সারাদেশের শ্রমিক লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা আমার পক্ষ থেকে দলের সাংগঠনিক কাজে উজ্জীবিত।
এদিকে, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে বাড়িতে অসামাজিক কার্যকলাপ পরিচালনার অভিযোগে মনির আহম্মদ মহিন নামে এক শ্রমিক লীগ নেতাসহ পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করে জেলা কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। মনির উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক। মনিরকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন তিনি। তার ঘরের দরজা খুলে মহিলা পুলিশের সহযোগিতায় অন্যান্য আসামিদের আটক করা হয়।
এ বিষয়ে জেলা শ্রমিক লীগের সদস্য সচিব বেলাল হোসেন ক্বারী বলেন, ‘দল কারো অপকর্ম সমর্থন করে না। মনিরের বিষয়টি আমাদেরকে কেউ জানায়নি। খোঁজ নিয়ে এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সোনালী বার্তা/এসআর