মোবাইল ফোনে আসক্তি: মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে শিশুরা
শৈশব কেড়ে নিচ্ছে ডিজিটাল ডিভাইস
ফোন ছাড়া শিশু কিছুতেই খেতে চায় না
বিরত রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা
কম বয়সে হারাচ্ছে দৃষ্টিশক্তি বাড়ছে একাকীত্ব
গেমসে আসক্তি বাড়াচ্ছে অপরাধপ্রবণতা
শিশুদের মোবাইল ফোন আসক্তি বাড়ছে। একে অপরের সঙ্গে শিশুদের মেলামেশা ক্রমশ কমছে, সে ক্ষেত্রে কথা শিখতেও দেরি হচ্ছে। কম বয়সে হারাচ্ছে দৃষ্টিশক্তি। বাড়ছে তাদের একাকীত্ব। শুরুর দিকে শিশুদের ইউটিউবে ভিডিও, মোবাইল গেমসে আসক্তি বাড়ছে। তবে কিশোরদের ক্ষেত্রে পাবজি, ফ্রি ফায়ারের মতো গেমসের আসক্তি দেখা যাচ্ছে। ফলে শিশুদের আচরণ তো বটেই পড়াশোনাতে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছে অপরাধমূলক কর্মকান্ডেও। বলতে গেলে তাদের শৈশব কেড়ে নিচ্ছে এই ডিজিটাল ডিভাইস। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এটির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে তাদের বুদ্ধির বিকাশ রুদ্ধ হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ঘরে টেলিভিশন থাকার পরও শিশুরা এখন মোবাইল ফোনেই বেশি আগ্রহী হয়ে পড়ছে। এতে করে শারীরিক ও মানসিক নানা ঝুঁকি রয়েছে বলেও মনে করছেন শিশু বিশেষজ্ঞরা।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, অভিভাবক বিশেষ করে কর্মজীবী মায়েরা তাদের শিশু সন্তানকে শান্ত রাখতে তার হাতে স্মার্টফোন বা ট্যাব দিয়ে দিচ্ছেন। গান, কার্টুন বা মজার ভিডিও চালিয়ে দিয়ে তাকে শান্ত রাখছেন। কখনো আবার স্কুল-কলেজসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে, অনলাইন ক্লাসের কারণে বাধ্য হয়েই অনেকে শিশুর হাতে তুলে দিতে হচ্ছে স্মার্টফোন। এ রকম করে দিনের অনেকটা সময় শিশুদের হাতে স্মার্টফোন থাকায় তাদের মধ্যে এক ধরনের আসক্তি জন্মাচ্ছে। যা থেকে শিশুদের বিরত রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিশু দৈনিক পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, সাধারণ শিশুদের চেয়ে তাদের বুদ্ধির বিকাশ কম হচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসরিন ওয়াদুদ বলেন, প্রতিনিয়ত ভিডিও গেম খেললে শরীরে এক ধরনের হরমোন নিঃসরণ হয়। এতে শিশু সব কিছু নিয়েই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে যায়। মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়।
এদিকে, জাতীয় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, এক হাত, বুক ও পেট পুরোটাই ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় শুয়ে আছে শিশু মুনতাহা। তার শরীরের ১২ শতাংশ পুড়ে গেছে। মোবাইল ফোনে ফায়ার গেমসে আসক্ত হয়ে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে গাজীপুরের ছয় বছরের শিশু রাফিয়া মুনতাহা। পরে নিজেই আবার আগুন নেভানোর চেষ্টা করে।
রাফিয়া মুনতাহার মা জিন্নাত জাহান জানান, তার মেয়ে স্মার্ট টিভিতে সার্চ করে ও পাশাপাশি স্মার্ট মোবাইল ফোনে বিভিন্ন ওয়েব সিরিজের কার্টুন দেখে থাকে। যেমন ফায়ার গেমসসহ অন্যান্য আরও অনেক কার্টুনের দেখে থাকে। সেই সব ওয়েব সিরিজের কার্টুনগুলোতে দেখা যায় নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে আবার নিভিয়ে ফেলে। কিন্তু কার্টুন তো কার্টুনই। ছোট শিশু না বুঝে সেসব কার্টুন দেখে চুলার সামনে গিয়ে তার শরীরের সুতির জামার এক অংশ তার দুই হাত দিয়ে মুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে আবার নেভানোর চেষ্টা করে কিন্তু নেভাতে পারে না। দাউ দাউ করে শরীরে আগুন ধরে যায়। পরে বাসার লোকজন তাকে জাপটে ধরে আগুন নিভিয়ে ফেলে। ততক্ষণে তার শরীরের অনেক অংশ পুড়ে যায়।
এদিকে, চক্ষু ও মানসিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের মত ইলেকট্রনিকস ডিভাইসের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তিতে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে প্রায় ৬ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের দৃষ্টি ও মানসিক সমস্যা নিয়ে ব্যাপক ভাবে চিকিৎসকের কাছে যেতে হচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিশুদের বয়স আট/নয় মাস, তখনও মায়েরা শিশুকে শান্ত করার জন্য তাদের হাতে মোবাইল অথবা ট্যাব দিয়ে, কোনো কার্টুন কিংবা অন্য কিছু দেখিয়ে শান্ত করতে চান।
মুবাররাত হোসেন এয়াদ (৫) বছর। সম্প্রতি মাস ছয়েক ধরে সে স্মার্টফোনে এতোটাই আসক্ত হয়ে পড়ছে যে, মেজাজ খিটমিটে হয়ে যাচ্ছে এবং কোনো কিছুর জন্য বায়না যখন ধরছে তখন দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আবদার অব্যাহত রাখছে। কথা হয় এয়াদ এর মায়ের সঙ্গে। তিনি সোনালী বার্তাকে বলেন, এয়াদ আমার বড় ছেলে। সে বুঝতে শেখার পর থেকে মোবাইল ফোন ও টেলিভিশনের দিকে ফিরেও তাকাতো না। কিন্তু আমি যখন ফের দ্বিতীয় সন্তানের মা হতে চলেছি তখন ছেলেকে একটু দুষ্টমি থেকে দূরে রাখতে বিশেষ করে যেহেতু তার সঙ্গে সব সময় ছুটাছুটি না করতে হয় সে জন্য মোবাইল ফোনে কার্টুন চালিয়ে ঘরের ভেতরে দেখতে দিয়ে আমি বিশ্রাম নিয়েছি। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বার মা হওয়ার পর নবজাতক সন্তানকে খেয়াল করতে গিয়ে বড় ছেলের হাতে মোবাইল ফোন ধরিয়ে দিয়েছি নিজ হাতে যেন খেয়ে ফেলে। এটাই এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছেলে এখন পড়াশোনা করতে চায় না। আগে সবার সঙ্গে মিলেমিশে খেলাধুলা করত আর এখন হুট করে রেগে যাচ্ছে, কাউকে সহ্য করতে পারছে না। বরং উচ্চস্বরে কথা বলতে থাকে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউশনের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. এস এম নাজমুল হাসান সোনালী বার্তাকে বলেন, মোবাইলের প্রতি আসক্তি শিশুদের সামাজিক দক্ষতা নষ্ট করেছে, যার জন্য শিশুদের নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। টিভি, মোবাইল গেম বা যেকোনো ধরনের ভার্চুয়াল এন্টারটেইনমেন্ট দেখার সময়ে আমাদের মস্তিষ্কের কোষ থেকে ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসরণ হয়। এ ডোপামিন আমাদের মনে এক ভালো লাগার অনুভূতি সঞ্চার করে। ফলে অতি সহজেই শিশুরা এ ধরনের এন্টারটেইনমেন্ট মিডিয়ামগুলোতে আসক্ত হয়ে পড়ে। তাই শিশুর স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করতে এবং তাদের চোখের বিশ্রামের জন্য স্ক্রিন থেকে পর্যাপ্ত সময় বিরতি নিতে উপদেশ দিতে হবে। তাদেরকে অবশ্যই সময় দিতে হবে।
তিনি বলেন, শিশু-কিশোরেরা ইউটিউব, টিকটক, ফেসবুক, গেমে আসক্ত হয়ে পড়াশোনা বিমুখ হচ্ছে। একইসঙ্গে তাদের পরিপূর্ণ মানুষিক ও শারীরিক বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব ডিভাইস। বাড়ছে অপরাধপ্রবণতাও। যার বড় প্রমাণ হচ্ছে কিশোর গ্যাং।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ সময় মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখার ফলে চোখের সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। শিশুদের পারিবারিক ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। তাই অভিভাবকরা শিশুদের মোবাইল ফোনে আসক্ত হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক না থাকে তাহলে আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ না হয়ে আগামী দিনের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এ জন্য শিশুদের মোবাইল ফোন থেকে দূরে রাখতে হবে। কোনো ভাবেই শিশুদের মোবাইল ফোনে আসক্ত হতে দেয়া যাবে না। তাদের নিকট মোবাইল ফোন ব্যবহার সীমিত করতে হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশে তাদের পর্যাপ্ত খেলাধুলার সুযোগ করে দিতে হবে। শিশুদের মোবাইল আসক্তি কাটাতে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন- ১. সন্তানকে সময় দিন। অধিকাংশ সময়ই শিশুরা একা থাকে। এ কারণে তারা মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ে। শিশু একাকীত্বে ভুগলে তা বিপদজ্জনক হয়ে উঠবে তার বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে। এ কারণে যতটা সম্ভব শিশুকে সময় দিন। ২. সমবয়সীদের সঙ্গে শিশুতে মিশতে শেখান। রোজ নিয়ম করে তাকে খেলতে নিয়ে যান। আজকাল অধিকাংশ শিশুর সময় কাটে বাড়িতে। এ কারণে ভার্চুয়াল দুনিয়া তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পায়। ৩.পড়াশোনার বাইরে খেলাধুলা, গান, ছবি আঁকা, সাঁতার শেখা- এসব কাজে শিশুদের যুক্ত করুন। এসব কর্মকা- তাকে মোবাইল আসক্তি থেকে দূরে রাখবে। ৪. অনেক অভিভাবকই আছেন কারণ ছাড়া সেলফি তোলেন, মোবাইল স্ক্রল করেন। অভিভাবকদের এমন আচরণ শিশুদেরও মোবাইলের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। এ কারণে সবার আগে মোবাইলের প্রতি অভিভাবকদেরও আসক্তি কমানো জরুরি। ৫. শিশুকে সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দিন। গাছ লাগানো, কাগজ কেটে হাতের কাজ করা, রং তুলি দিয়ে ছবি আঁকার অভ্যাস করালে শিশুর মোবাইলের প্রতি আগ্রহ কমবে। মোবাইল না দিয়ে শিশুকে গল্প শোনাতে শোনাতে খাওয়াতে পারেন। ৬. সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত সময় কাটানো আপনার অজান্তেই হতে পারে মানসিক চাপ। এ কারণে সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারের সময় নির্দিষ্ট রাখুন। এতে আপনি ও শিশু দু’জনই ভালো থাকবেন।
জানতে চাইলে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. স্বপন রায় সোনালী বার্তাকে বলেন, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ক্রমশ শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারে আসক্তি বাড়ছে। শহরের সাথে পাল্লা দিয়ে এখন গ্রামাঞ্চলেও র্স্মাট মোবাইল ফোনে শিশুদের আসক্তির হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে শিশুদের আচরণেও দেখা দিচ্ছে নানা নেতিবাচক পরিবর্তন। শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক ভাবেও হয়ে পড়ছে অসুস্থ।
তিনি বলেন, করোনা মহামারির সময় স্কুল-কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাসের কারণে বাধ্য হয়েই শিশুর হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল স্মার্ট মোবাইল ফোন। তখন নানা কারণে দিনের অনেকটা সময় হাতে থাকায় এটি এখন এক ধরনের আসক্তিতে রূপ নিয়েছে। তাছাড়া কিছুটা দায় অভিভাবকদেরও আছে। যেমন অনেক মায়েরাই শিশুদের ঘরে রাখতে গেমস ও কার্টুন দেখে সময় কাটানোর জন্য স্মার্ট মোবাইল ফোন ধরিয়ে দিচ্ছেন। এমনকি মোবাইল ফোন ব্যবহারে ক্ষতির দিক জেনেও সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য মোবাইল ফোনই একমাত্র মাধ্যম বলে বেছে নিয়েছেন অনেক অভিভাবকরা। এর ফলে শিশু মেধা শূণ্য হয়ে পড়ছে। তাই অভিভাবক সচেতন হলেই এর হার কমে আসবে বলে মনে করছেন তিনি।
ময়মনসিংহ বিভাগের বিভিন্ন জেলার কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীর অভিভাবক সোনালী বার্তাকে জানান, স্কুল ফাঁকি দিয়ে ফোন নিয়ে পড়ে থাকে তাদের সন্তান। আবার ফোন কিনে না দিলেও স্কুল যাওয়া বা নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। এমনকি আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে আদায় করছে ফোন। অনেকটা নিরুপায় হয়ে ফোন কিনে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা (অভিভাবক)।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শহরে খেলার মাঠের অভাব এবং ঘরের বাইরে নিরাপত্তা কম থাকার কারণে শিশুরা বাইরে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবে খেলতে পারছে না। যদিও ডিজিটাল ডিভাইস দুনিয়াকে পালটে দিয়েছে। তারপরও মোবাইল আসক্তি শিশুদের যে ক্ষতি করেছে তা অপূরণীয়। মানবজাতির বিস্ময়কর অগ্রগতির বিস্ময়কর পিছনে ডিজিটাল ডিভাইসের অবদান যেমন অনস্বীকার্য ঠিক তেমনি আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই আমরা যেমন অগ্রগতির দিকে নজর রাখব ঠিক তেমনি আগামীর ভবিষ্যত শিশুদের যেন এই মোবাইল আসক্তির কারণে অধঃপতন না হয় সে দিকেও গুরুত্ব দেব। শিশুদের স্বার্থেই তাদের ডিজিটাল ডিভাইস থেকে দূরে রাখতে হবে। আমাদের সাবধান হতে হবে, সরে আসতে হবে এই আতœঘাতী বোকামী থেকে।
সোনালী বার্তা/এসআর