‘রেয়াজের কোন বিকল্প’ই নেই’
সঙ্গীতশিল্পী সমরজিৎ রায়, সুর তাঁর ধ্যানজ্ঞান, সুরই তাঁর একমাত্র প্রার্থনা, শুধুমাত্র সঙ্গীতকেই করেছেন তিনি জীবনের ধ্রুবতারা। তাঁর গৃহে প্রবেশমাত্রই অরুণ রাঙা প্রভাত প্রার্থনায় শুনতে পাওয়া যায় ভৈরবী রাগে অনুরাগ রঞ্জিত নিজেকে সঁপে দেয়ার আকুল আবেদনের অসাধারণ আবহ। সকল সময়ে যিনি সুরের মহাসমুদ্রে অবগাহন করে থাকেন, সদা সাধনায় নিমগ্ন থাকেন, এই সময়ের ভীষণ মেধাবী ও চর্চিত কণ্ঠের অধিকারী, স্বমহিমায় উদ্ভাসিত শাস্ত্রীয় ধারার জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী সমরজিৎ রায়। সারা ভারতের গান্ধর্ব মহাবিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিশারদের চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করায় তিনি অর্জন করেছিলেন পন্ডিত ডি.বি পলুস্কর পুরস্কার সহ মোট ৮টি সম্মানজনক পুরস্কার। তাঁর প্রথম হিন্দি গানের অ্যালবাম “তেরা তসব্বুর” ২০১১ সালে ভারতের খুবই সম্মানজনক ‘জিমা অ্যাওয়ার্ড’ এ “সেরা জনপ্রিয় অ্যালবাম” বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছিল। বাংলাদেশের সেরা শিল্পী হিসেবে “লাক্স আরটিভি স্টার অ্যাওয়ার্ড ২০১৫” এর সম্মান পান তিনি। সমরজিৎ বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ও শিল্পকলা একাডেমির তালিকাভুক্ত একজন নিয়মিত সঙ্গীতশিল্পী। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তিনি তালিকাভুক্ত সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালকও বটে।
শাকিব খান অভিনীত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ‘অন্তরাত্মা’তে তিনি প্লেব্যাক করেছেন। তাছাড়া ভারত ও বাংলাদেশে নির্মিত বিভিন্ন ডকুমেন্টারি ফিল্ম সহ বেশ কিছু নাটকেও তিনি টাইটেল গান গেয়েছেন। সমরজিতের সুর ও সঙ্গীত পরিচালনায় কিংবদন্তি শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা এবং ইন্দ্রানী সেনের সঙ্গে গাওয়া তাঁর দ্বৈত কন্ঠের গানগুলো ভীষণ শ্রোতাপ্রিয় হয়। সমরজিতের সুর ও সঙ্গীতে রেকর্ডকৃত কিংবদন্তি শিল্পী অনুপ জলোটার কণ্ঠে বেশ কিছু বাংলা গানও ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাছাড়া বাংলা গানের কিংবদন্তি গীতিকার পুলক বন্দোপাধ্যায় ও বটকৃষ্ণ দের লেখা এবং কিংবদন্তি সুরকার মৃণাল চক্রবর্তী ও অজয় দাসের সুরে বেশ কিছু মৌলিক গান রেকর্ড করার সৌভাগ্যও হয়েছে শিল্পী সমরজিৎ রায়ের। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে দিল্লীর গান্ধর্ব মহাবিদ্যালয়ে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন সমরজিৎ। কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্লাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন ‘সুরছায়া সঙ্গীত পাঠশালা’।
আজ আমরা কথা বলবো সঙ্গীতের এই বরপুত্রের সঙ্গে, যাঁর দরদমাখা কন্ঠ থেকে নিঃসৃত সুর নিমিষেই মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে শ্রোতাদের এক অনন্য নান্দনিক মাদকতায় আবিষ্ট করে রাখে।
সোনালী বার্তা: কেমন আছেন আপনি?
সমরজিৎ রায়: খুব ভালো আছি।
সোনালী বার্তা: এবারের ঈদে আপনার কোন গান প্রকাশিত হবে কি?
সমরজিৎ রায়: কিছুদিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে আমার মৌলিক গান ‘ইচ্ছেগুলো’, যা শ্রোতারা ভীষণ পছন্দ করেছেন। ভীষণ ইচ্ছে ছিলো ঈদে একটি গান প্রকাশ করার। সেটা হয়ে ওঠেনি। তবে আশা করছি কিছু সময়ের মধ্যেই নতুন গান নিয়ে হাজির হবো।
সোনালী বার্তা: শিল্পীদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু বলে মনে করেন?
সমরজিৎ রায়: আমি মনে করি একজন শিল্পীর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। সঙ্গীতকে যদি আমরা নেশা বা পেশা হিসেবে নিই তাহলে তার গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা না করলে আমার মনে হয় সঙ্গীত জীবন অপূর্ণই থেকে যায়। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা আমাদের সুরের গভীরে নিয়ে যাওয়ার এই কাজটিই করে। তাছাড়া সুরের উপর দখল আনা বা কণ্ঠস্বর দীর্ঘস্থায়ী করতেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে হয়।
সোনালী বার্তা: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শুধুমাত্র সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে নেয়া কতোটা ফলপ্রসূ?
সমরজিৎ রায়: আমি নিজেও সঙ্গীতের বাইরে কিছুই ভাবতে পারিনি কোনদিন। সঙ্গীত আমার নেশা এবং পেশা দুটোই। তারপরেও আমার এতোদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলবো আমাদের দেশে সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে না নিতে পারলেই মনে হয় ভালো। সঙ্গীতকে সঙ্গে রেখে জীবিকার তাগিদে আর্থিক বিষয়ের জন্য অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল হওয়া উচিৎ। যদিও এই কাজ আমি নিজেও কোনদিন করতে পারবো না। তাও এই কথাগুলো না বলে পারলাম না।
সোনালী বার্তা: সঙ্গীতশিল্পী, নাকি সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে নিজেকে ভাবতে বেশি ভালো লাগে?
সমরজিৎ রায়: আসলে সত্যি কথা হলো দু’টোর অনুভূতি দু’রকম। দু’টোই ভীষণ ভালো লাগার বিষয় আমার কাছে। শিল্পী হিসেবে শ্রোতাদের মনের গভীরে প্রবেশ করে তাঁদের পরমাত্মীয় হয়ে ওঠা যেমন অনেক সুখের, ঠিক তেমনি সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গীত জীবনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে সঙ্গীত শিক্ষার আদান প্রদান করা এবং নিয়মিতভাবে তাঁদের জীবনের সুখ দুঃখ ভাগ করে প্রতিটি মুহূর্ত কাটানোর আনন্দও কম নয়।
সোনালী বার্তা: কিভাবে শুরু হলো ‘সুরছায়া’?
সমরজিৎ রায়: দিল্লীতে থাকাকালীন অসংখ্য ছাত্র ছাত্রীদের তৈরি করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার নিজের দেশের সঙ্গীত শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু একটা করার দায়বদ্ধতা মনে মনে থেকেই গিয়েছিল। কোভিড এর প্রাদুর্ভাব যখন শুরু হলো, সবাই ঘরবন্দী হয়েই ছিলাম। সেই সময়ে উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা দিদিকে একদিন ফোনে আমার ইচ্ছের কথা জানালাম যে অনলাইনে একটি ক্লাস শুরু করতে চাই। উনি সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হলেন। তখনই আমরা ‘সুরছায়া’ শুরু করি। এর দুই বছর পর থেকে দিদির ব্যস্ততা শুরু হওয়ার কারণে আমি একাই এটি পরিচালনা করছি এখন। বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গীত শিক্ষার্থীরা সুরছায়ার ক্লাসে নিয়মিত অংশ নিয়ে থাকেন।
সোনালী বার্তা: ঘুরে ফিরে পুরোনো দিনের গানগুলোই কেন আমাদের মনে দোলা দেয়? তাহলে কি এখন ভালো কোন নতুন গান সৃষ্টি হচ্ছে না?
সমরজিৎ রায়: আগেকার দিনের প্রতিটি গানই ছিল তখনকার শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক থেকে শুরু করে যন্ত্রশিল্পীদের অনেক পরিশ্রমের ফসল। তাঁরা গানটাকে হৃদয়ে লালন করতেন এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উপর কম বেশি সবারই দখল ছিল। প্রতিটি গানের সৃষ্টির জন্য অনেক সময়ও দিতেন তাঁরা। তাই হয়তো সেই গানগুলো আজ অব্দি আমরা শুনে যাচ্ছি। আর এখন ভালো নতুন গান সৃষ্টি হচ্ছে না কথাটি পুরোপুরি সত্যি নয়। এখনকার অনেক গানও ভীষণ শ্রুতিমধুর এবং অনেকেই ভীষণ ভালো গাইছেন।
সোনালী বার্তা: নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য কোন পরামর্শ?
সমরজিৎ রায়: আমি নিজেই সুর খুঁজে বেড়াচ্ছি সঙ্গীতের মহাসাগরে। সুর লাগানোর চেষ্টা করি, সুর তো লাগেনা। সুরের দেখা পাইনা। পরামর্শ দেওয়ার কোন যোগ্যতাই আমার নেই। শুধু এইটুকু বুঝেছি, রেয়াজের আসলে কোন বিকল্পই নেই। আমি মনে করি একজন সদ্যজাত বাচ্চার যেভাবে যত্ন নিতে হয়, ঠিক তেমনি স্বরেরও নিয়মিতভাবে যথাযথ যত্ন নেওয়া উচিৎ। সঙ্গীত গুরুমুখী বিদ্যা।
যে কোন শিল্পীর জীবনে সঠিক একজন গুরুর গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া সঙ্গীতের মতো এমন মহাসমুদ্রের একটি বিষয়কে আমরা নেশা বা পেশা হিসেবে নিতে চাইলে কোন অজুহাত না দেখিয়ে সেটার পিছনে জীবনের কতোটা সময় ব্যয় করা উচিৎ সেটা শিল্পীদেরই বুঝে নিতে হবে।
সোনালী বার্তা: ‘অজুহাত না দেখিয়ে’ এই কথাটি কেন বললেন?
সমরজিৎ রায়: এই জন্যই বললাম, কারণ অনেক পেশাদার এবং অপেশাদার শিল্পীদের কাছেও মাঝে মাঝে শুনি যে অনুষ্ঠান এবং নানান ব্যস্ততার কারণে রেয়াজের জন্য তাঁদের কাছে সময় নেই। তাঁদের এই কথায় আমার ভীষণ আপত্তি আছে। আমি মানতেই পারিনা যে, দৈনন্দিন কাজের জন্য আমাদের হাতে ঠিকই সময় থাকে, অথচ রেয়াজের জন্য সময় নেই।
আমি মনে করি, যে কোন বিষয় বা যে কোন মানুষের জন্য আমাদের সময় থাকা না থাকা নির্ভর করে আমাদের জীবনে সেই বিষয় বা সেই মানুষগুলোর গুরুত্বের উপরই। একটু ভাবলেই নিশ্চয় আমার সঙ্গে সবাই একমত হবেন যে, যাঁদের আমরা সময় দিতে চাইনা তাঁদের আমরা সবসময় ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। আর যাঁদের সময় দিতে চাই, শত ব্যস্ততার মধ্যে ঠিকই তাঁদের জন্য আমরা সময় বের করে নিই। এটাই বাস্তবতা। তাই আমাদের বুঝে নিতে হবে সঙ্গীত আমাদের জীবনে কতোটা গুরুত্ব নিয়ে ঠিক কতোটা জায়গা জুড়ে রয়েছে।
এমআর