উপেক্ষিত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা : মতিঝিলের ৯৯ ভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠানেই ‘মুক্তা পানি’ পাওয়া যায় না
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক প্রচেষ্ঠায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ধীন শারীরিক প্রতিবন্ধী সুরক্ষার ট্রাস্ট, মৈত্রী শিল্পে প্রতিবন্ধীদের দ্বারা তৈরি হচ্ছে মুক্তা পানি। অন্তত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেন; মুক্তা পানি ব্যবহার করা হয় এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিক বার তাগিদও দিয়েছেন। তারপরও বঙ্গভবন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়, ওয়াপদা, বিদ্যুৎ ভবন, বাংলাদেশ সচিবালয়ের প্রতিটি মন্ত্রণালয় ছাড়া অন্যান্য সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত মুক্তা পানি ব্যবহার হচ্ছে না। এমনকি রাজধানীর প্রসিদ্ধ হোটেলগুলোতেও দেখা মেলে না মুক্তা পানি’র উপস্থিতি। অথচ এই মুক্তা পানি দেশে প্রচলিত অন্যান্য বোতলজাত নিম্নমানের পানির চেয়ে স্বচ্ছ ও ফ্রেশ। গুণগত মানের দিক থেকেও শীর্ষে।
আমাদের দেশের প্রতিবন্ধীরা তৈরি করছেন ‘মুক্তা পানি’ মিনারেল ওয়াটারের বোতল। এর কারখানা গাজীপুরে। বিশেষত্ব হল এই কারখানাটি সম্পূর্ণভাবে প্রতিবন্ধীরা পরিচালনা করেন। এখান থেকে যে লাভ হয় তার পুরো অংশ প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে ব্যয় করা হয়। এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রতিবন্ধীদের তৈরি মুক্তা পানি সবাইকে কিনতে বলেছেন। ওই অনুষ্ঠানে অটিস্টিকদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিজেদের প্রতিভা দিয়ে এরা অনেক কিছু তৈরি করতে পারে। এসময় মুক্তা পানি মিনারেল ওয়াটারের বোতল হাতে নিয়ে সবাইকে দেখিয়ে বলেন, এটি কিন্তু আমাদের প্রতিবন্ধীরাই তৈরি করছে। এসময় এই পানি কেনার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষিত রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সমৃদ্ধ অর্থনৈতির অগ্রযাত্রায় মৈত্রী শিল্পের প্রতিবন্ধীরাও কাজ করে যাচ্ছেন তার বড় প্রমাণ এই মুক্তা পানির উৎপাদন প্রক্রিয়া। অথচ গুণগত মানের জন্য এই বোতলজাত পানি বাজারে তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। তবে মুক্তা পানি কর্তৃপক্ষ বলছে, উৎপাদন সক্ষমতা কম থাকায় বাজারে এই পানি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। পৌঁছানো যাচ্ছে না প্রতিটি দোকানে।
বর্তমানে বাজারে বোতলজাত পানি পাওয়া যাচ্ছে- কিনলে, মাম, অ্যাকুয়াফিনা, স্পা, প্রাণ, জীবন, ডেইলি, ফ্রেশ ও ক্রিস্টাল। কিন্তু নিদিষ্ট কিছু জায়গা ছাড়া দেখা মেলে না সরকারি মুক্তা পানির। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় করপোরেট শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদিত বোতলজাত পানি আনাচে-কানাচে পৌঁছে গেলেও সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত মুক্তা পানি কেন পৌঁছে না- এনিয়ে নানা প্রশ্নও রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে মুক্তা পানিকে সংকুচিত রাখার পেছনে বোতলজাত পানি উৎপাদনকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কেউ কেউ কাজ করে যাচ্ছেন। অথচ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি বিশুদ্ধ পানির কারখানায় অত্যাধুনিক রিভারস অসমোসিস(আরও)প্রক্রিয়া ব্যবহার করে মুক্তা পানি প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে। এ পানির ব্র্যান্ডটির উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিয়োজিত সবাই শারীরিক প্রতিবন্ধী। এই পানি থেকে আয়কৃত অর্থের পুরোটাই ব্যয় হয় শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য।
অবশ্য মুক্তা পানি’র নির্বাহী পরিচালক সেলিম খান সোনালী বার্তাকে বলেন, মুক্তা পানি চাহিদা তুলনায় উৎপাদন ঘাটতি আছে। চেষ্টা করা হচ্ছে সেই উৎপাদন ঘাটতি পূরণে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিগগিরই আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মুক্তা পানি’র ব্যবহার বিষয়ে কথা বলব; তাদের সঙ্গে আলোচনায় অনুরোধ করব; যেন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অন্তত একটি পরিপত্র জারি করে সরকারি অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে মুক্তা পানির ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে নির্দেশনা দেয়া হয়।
এদিকে রাজধানীর মতিঝিল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা দোকানিরা মুক্তা পানি সম্পর্কে কিছুই জানে না। আর যারা জানেও তারা এই পানির দেখা পান না বলে জানিয়েছেন।
রাজধানীর মতিঝিল এলাকা মূলত ব্যাংক-পাড়া হিসেবে পরিচিত। যেখানে বেসরকারি কিংবা ব্যক্তিমালকানার তুলনায় সরকারি প্রতিষ্ঠানই বেশি। কিন্তু সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়; মতিঝিল এলাকায় অবস্থিত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে মুক্তা পানি ব্যবহার করা হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক-রুপালি ব্যাংক, জনতা ব্যাংকগুলোসহ অন্যান্য সরকারি ব্যাংকগুলোতে নেই মুক্তা পানির ব্যবহার। আর্থিক প্রতিষ্ঠান জীবনবীমা ও সাধারণ বীমা প্রতিষ্ঠানেও সন্ধান মেলেনি মুক্তা পানির। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট এলাকার হোটেল পূর্বাণী, হীরাঝিল হোটেল, ঘরোয়া হোটেল এন্ড রেস্তোরা, সুপার স্টার, ইত্তেফাক মোড়ে বিএফসি, বংশালের আল রাজ্জাক হোটেলসমূহে মুক্তা পানি রাখা হয় না।
জানতে চাইলে হীরাঝিল হোটেলে কর্মরত জাফর আহমেদ সোনালী বার্তাকে বলেন, এই প্রথম মুক্তা পানির কথা শুনলাম। পানিটা কেমন সেটাও জানি না, যেহেতু পানি চোখে দেখা হয়নি। আমাদের এখানে মুক্তা পানি নিয়ে কেউ আসেননি তাই রাখা হয় না।
অবশ্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন উপ-পরিচালক সোনালী বার্তাকে বলেন, নিয়মিত না হলেও অনিয়মিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে মুক্তা পানি ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকে কোনো প্রোগ্রাম থাকলে এই মুক্তা পানি ব্যবহার করা হয়। অন্যথায় অন্যান্য ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানি ব্যবহার করা হচ্ছে।
শারীরিক প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকারের সহায়তায় মৈত্রী শিল্পের উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন প্রকল্পের আওতায় ‘মুক্তা ড্রিংকিং ওয়াটার প্লান্ট’স্থাপন করা হয়। বিশ্ব বিখ্যাত আমেরিকান ওয়াটার পিউরিফিকেশন অ্যান্ড বটলিং প্লান্ট মেশিনারিজ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সেল এ্যাকুয়া টেকনোলজিস ইনকরপোরেট হতে আমদানিকৃত মুক্তা ড্রিংকিং ওয়াটার প্লান্ট। মুক্তা বোতলজাত সুপেয় পানি অত্যাধুনিক মেশিন দ্বারা ১১টি ধাপে রিভার্স অসমোসিস পদ্ধতিতে পরিশোধিত হয়। উৎপাদন কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের সার্বক্ষণিক হাইজেনিক চেক, পরিস্কার-পচ্ছিন্নতা ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়। প্রতি ব্যাচে উৎপাদিত মুক্তা বোতলজাত সুপেয় পানি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা ও গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। মুক্তা বোতলজাত বিশুদ্ধ পানির মিনারেল কম্পোজিশন বাজারে প্রচলিত অন্যান্য বোতলজাত পানির তুলনায় ভারসাম্যপূর্ণ, যা মানবদেহের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব(বাজেট, কার্যক্রম ও মূল্যায়ন) নজরুল ইসলাম সোনালী বার্তাকে বলেন, মুক্তা পানি স্বচ্ছ ও ফ্রেশ। কিন্তু চাহিদা কম এবং উপাদন সক্ষমতা কম। তাই সব জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মুক্তা পানির উৎপাদন বাড়ানো ও বাজারজাত করার পরিকল্পনা অব্যাহত আছে।’