মাদারীপুরে দুই ছেলেকে শ্বাসরোধে হত্যা করে পুড়িয়ে দেন মা পূর্ণিমা বৈদ্য

সম্প্রতি তাকে জামিন দেন মাদারীপুরের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক। এরপর তাকে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যায় যাওয়া হয়। দুদিন পরে শ্বশুরবাড়ি থেকে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে পালিয়ে যান পূর্ণিমা। এরপর বাদীপক্ষের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিয়ে হুমকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে পূর্ণিমা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে।
জানা যায়, ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর সকালে মাদারীপুর সদর উপজেলার উত্তর ঝিকরহাটি গ্রামের গোলাম মাওলা মাতুব্বরের মালিকাধীন একতলা টিনশেড ঘরে আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পান এলাকাবাসী। পরে ঘরের তালা ভেঙে পানি ছিটিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন তারা। খবর পেয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। আগুন নিয়ন্ত্রণের আগেই ঘরের ভেতর পুড়ে মারা যায় এক বছরের একটি শিশু। এ সময় গুরুতর আহত আড়াই বছর বয়সী ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকেও মৃত ঘোষণা করেন।
এই ঘটনায় দুই নাতিকে হত্যার কথা উল্লেখ করে সদর মডেল থানায় নিহত রুদ্র বৈদ্য (আড়াই বছর) ও মানিব বৈদ্য (এক)-এর দাদু কালিদাস বৈদ্য দুজনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করে। মামলায় দুই সহোদর ভাইয়ের মা পূর্ণিমা বৈদ্য (২২) ও পূর্ণিমা বৈদ্যের মা রেবা বাড়ৈকে (৬০) আসামি করা হয়।
ঘটনার পর দিন ৬ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকার পল্টন থানার কাকরাইল এলাকা থেকে পূর্ণিমাকে গ্রেফতার করে সদর মডেল থানার পুলিশের একটি চৌকস দল। পরে তাকে আদালতে তোলা হলে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক। এই ঘটনায় সদর মডেল থানার এসআই ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তন্ময় মণ্ডল ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকায় পূর্ণিমা বৈদ্যের নামে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। তদন্তে দোষ না পাওয়ায় অভিযোগপত্র থেকে পূর্ণিমার মা ও মানিকের শাশুড়িকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্র সূত্রে জানা যায়, বরিশালের উজিরপুর উপজেলার নাথারকান্দি গ্রামের গৌরাঙ্গ বাড়ৈর মেয়ে পূর্ণিমার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের জেরে বিয়ে হয় মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া গ্রামের কালিদাস বৈদ্যের ছেলে মানিক বৈদ্যের। বিয়ের পরপরই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক কলহে ঝগড়া হতো। পরবর্তীতে পূর্ণিমার কোলজুড়ে দুটি সন্তান আসে। সন্তানদের ভরণপোষণ না দেয়ায় পারিবারিক কলহ বেড়ে যায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। ঘটনার দিন ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর সকালে পূর্ণিমা ও মানিকের মধ্যে ফোনে কথা হয়। সন্তানদের কোন দায়-দায়িত্ব মানিক নিতে পারবে না মর্মে পূর্ণিমাকে জানায়। পাশাপাশি পূর্ণিমার সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ রাখবেও না বলে মানিক জানিয়ে দেয়। এতে রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে দুই সন্তানকে হত্যা করে স্বামীর প্রতি প্রতিশোধ নেয়ার চিন্তা করেন পূর্ণিমা। পরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দুই সন্তানকে মোবাইলের চার্জারের তার দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে ঘরে তালা দিয়ে পালিয়ে যায় পূর্ণিমা। পালিয়ে যাবার সময় ঘরে থাকা জামাকাপড়ে আগুন ধরিয়ে দেয় সে।
মামলার বাদী কালিদাস বৈদ্য জানান, সম্প্রতি মামলার তারিখে আদালতে তোলার সময় আমাকে দেখে হাতেপায়ে ধরে মাফ চায় পূর্ণিমা। মানবিক কারণে ছেলে মানিকের কথা চিন্তা করে আদালতে মীমাংসার জন্য কাগজ জমা দেই। পরে বিচারক পূর্ণিমাকে জামিন দিলে পুত্রবধূকে বাড়িতে নিয়ে আসি। এর দুদিন পরে বাড়ি থেকে সব টাকাপয়সা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে পালিয়ে যায় সে। পরে পূর্ণিমার ভাই রাজু বাড়ৈ ও তার লোকজন একাধিক মোবাইল নাম্বার দিয়ে আমাদের ফোনে কল দিয়ে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। আমরা এখন নিরুপায় হয়ে পড়েছি। মামলার পরবর্তী তারিখে মীমাংসার কাগজ প্রত্যাহার করে নেব।
মাদারীপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট মোসলেম আকন বলেন, জামিনে বেরিয়ে এসে বাদীপক্ষকে হুমকি দিলে থানায় জিডি করতে হবে। সেই জিডির কপি আদালতে জমা দিলে শুনানি শেষে আসামির জামিন বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বিচারক। আর আপোষ-মীমাংসা হলে সেটা প্রত্যাহার বাদী চাইতে পারেন। সেটার সিদ্ধান্তও নেবেন আদালত।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তন্ময় মণ্ডল বলেন, আসামি দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন, জামিনে বেরিয়ে এসে বাদীপক্ষকে হুমকি দেয়ার কথা নয়। যদি এমন হয় খোঁজখবর নেয়া হবে। থানায় লিখিত দিলে তদন্ত করে পরবর্তীতে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মাদারীপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএইচএম সালাউদ্দিন বলেন, মানিকের সঙ্গে তার স্ত্রী পূর্ণিমার পারিবারিক বিরোধের কারণেই দুই শিশু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আদালতে দাখিল করা অভিযোগ পত্রে সেটাও উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত মানিক চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই কাজ করে বেড়ায়। মানিকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। এই দুই শিশু হত্যার বিচার হোক, সেটা থানা পুলিশও প্রত্যাশা করে। আর জামিনে বেরিয়ে বাদীপক্ষকে হুমকি-ধামকি দিলে সেই বিষয়ে থানায় অভিযোগ দিলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া মানিকের কোন দোষ থাকলে তাকেও ছাড় দেয়া হবে না।
এদিকে পূর্ণিমা বৈদ্য ও তার পরিবারের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে একাধিকার কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। এজন্য বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
সোনালী বার্তা/ এমএইচ