মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫, ০৯:৫৯ পূর্বাহ্ন

সুন্দরবনের এবারের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অন্তত ৪০ বছর লাগবে

নিজস্ব প্রতিবেদক / ১৯৪ Time View
Update : বুধবার, ২৯ মে, ২০২৪

ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ও আম্পানের আঘাতের চেয়ে এবার রিমালে বনের ক্ষতির পরিমাণ দুই-তিনগুণ বেশি। ১১ কিলোমিটার এলাকার গোলপাতা বন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জোয়ার-ভাটার চক্রে পুরো সুন্দরবন ৪৮ ঘণ্টা ৩ থেকে ৯ ফুট পানির নিচে ছিল। ফলে পশুপাখির বাসা, ডিম ও বাচ্চা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বনের ভেতরে জীববৈচিত্র্য যেমন হরিণ, শুকর, গুইসাপ, সাপ ও বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। বনের পুকুরগুলো লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

বন বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বনের ১২ হাজার ৩৫৮টি গাছ ভেঙে পড়েছিল। বন বিভাগের অবকাঠামোর ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল দুই কোটি ১৫ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে বুলবুলের আঘাতে বনের চার হাজার ৫৮৯টি গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অবকাঠামোর ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়ে ছিল ৬২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। রিমালের আঘাতে ক্ষতির পরিমাণ ছয় কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বুলবুল ও আম্পানের চেয়ে রিমালের আঘাতে তিন গুণ বেশি গাছপালা, পশুপাখি, প্রাণী ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। এবারের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অন্তত ৪০ বছর লাগবে বলে জানিয়েছেন বন কর্মকর্তা ও পরিবেশবিদরা।

কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে জানতে চাইলে সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‌পশ্চিম সুন্দরবনের আওতায় খুলনা ও সাতক্ষীরায় অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ দুই কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে পন্টুন গ্যাংওয়ে একটি, জেটি ১৮টি, মিষ্টি পানির পুকুর ১৪টি লবণাক্ততায় পরিণত হয়েছে। বন বিভাগের ৯টি অফিসের দুই হাজার ৬৩০ ফুট রাস্তা, বনকর্মীদের তিনটি ব্যারাক, আটটি সোলার প্লেট, দুটি ওয়্যারলেস টাওয়ার, দুটি জেনারেটর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বুড়িগোয়ালিনী, নলিয়ান ও বানিয়াখালি এলাকার ১১ কিলোমিটার গোলপাতা বন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘সুন্দরবনজুড়ে পাখির হাজার হাজার বাসা ছিল। সেসব বাসায় ডিম ও বাচ্চা ছিল। সেই ক্ষতি পরিসংখ্যান দিয়ে নিরূপণ করা কঠিন। হরিণগুলোর মৃতদেহ গণনা করা গেলেও ভেসে যাওয়ার হিসাব মিলবে না। ঝড়ের সময় সুন্দরবনে ৪৮ ঘণ্টা ভাটা দেখা যায়নি। ৯ ফুট পানির নিচে ছিল বন। অথচ তিন ফুটের নিচের প্রাণীগুলো এত পানিতে টিকতে পারে না। তাদের অবস্থা নিরূপণ করা যাবে না। সাপ ভাসলেও পানিতে থাকারও নির্দিষ্ট সময় আছে। সেক্ষেত্রে মৃত্যু অনেকটা নিশ্চিত। ফলে এসব প্রাণীর ক্ষতি নিরূপণ করা একেবারেই অসম্ভব। আমরা দুটি হরিণের মৃতদেহ পেয়েছি। আটটি জীবিত অবস্থায় পেয়েছি। এর মধ্যে দুটি এখনও সেবার আওতায় আছে। ছয়টিকে বনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। জোয়ার-ভাটার সময়ের ব্যবধান ৪৮ ঘণ্টা ব্যাপী স্থায়ী হওয়ার ক্ষতির সঠিক পরিসংখ্যান দেওয়া যাবে না। কারণ বাস্তবে ক্ষতির ব্যাপকতা অনেক বেশি। প্রাণী মৃত্যুও অন্যান্য ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে বেশি।

অবকাঠামোগত ক্ষতি অর্থ দিয়ে ফিরিয়ে আনা সম্ভব জানিয়ে এই বন কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘কিন্তু বনের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি অর্থ দিয়ে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। এই ক্ষতি সুন্দরবন নিজেই কাটিয়ে উঠতে পারবে। সেজন্য তাকে সময় দিতে হবে। বিরক্ত করা চলবে না। অন্তত প্রাকৃতিকভাবে ঠিক হতে তার ৪০ বছর লাগতে পারে।

বন বিভাগ সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে কাজ শুরু করেছে। বনের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গেছে বন্যপ্রাণীর মৃতদেহ। মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, ৩০টি হরিণের মৃতদেহ পাওয়া গেছে এবং ১৭টি জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। উঁচু স্থান এবং গাছে আশ্রয় নিতে না পেরে প্রাণীদের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন বিভাগের ২৯টি টহল ফাঁড়ি। লবণপানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে মিঠাপানির সব পুকুর।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাধারণত জলোচ্ছ্বাস হলে বন্যপ্রাণীরা উঁচু স্থান ও গাছে আশ্রয় নেয়। রিমালের তাণ্ডবে বনের ভেতর অধিক উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। ফলে বনের উঁচু স্থান তলিয়ে যাওয়ায় প্রাণীরা আশ্রয় নিতে পারেনি। অধিক জলোচ্ছ্বাসের ফলে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে না পেরে হরিণগুলোর মৃত্যু হয়েছে।

বনের পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. নুরুল কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রিমালের আঘাতে অন্তত তিন কোটি টাকার অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে। সাগর এখনও উত্তাল থাকায় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ক্ষতির চূড়ান্ত হিসাব করা যাচ্ছে না। বন বিভাগের বিভিন্ন অফিস, টহল ফাঁড়ি এবং মিঠাপানির পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুবলা, শ্যালা, আলোর কোল, কটকা, কচিখালীর জেটি ক্ষতি হয়েছে। পুকুর তলিয়ে লবণাক্ত পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে। মৃত প্রাণীগুলো মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। জীবিত উদ্ধার প্রাণীগুলোকে সেবা দিয়ে বনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। করমজল, কটকা, কচিখালী, দুবলার চরে রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বনের ২০টি স্টেশন ও ৫০টি পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে ক্ষতি নিরূপণ করা কঠিন।

বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বনের বিভিন্ন স্থান থেকে মোট ৩০টি মৃত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে এবং আহত অবস্থায় আরও ১৭টি উদ্ধার করেছেন বনরক্ষীরা। এছাড়া টহল অফিসগুলোর টিনের চাল, জানালা-দরজা, সোলার প্যানেল এবং ওয়্যারলেস সিস্টেমের ক্ষতি হয়েছে। তবে হরিণের পাশাপাশি আরও বন্যপ্রাণী মারা গেছে। সেসব মৃত প্রাণীর খোঁজে তৎপর রয়েছেন বনরক্ষীরা।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বুলবুল, আম্পান, আইলা ও সিডর ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও রিমালের মতো এতটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ফলে এর আঘাতে সুন্দরবন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে ৪৮ ঘণ্টা ভাটা পড়েনি। যা জীববৈচিত্র্যের প্রাণহানির প্রধান কারণ। বাঘ পানিতে সাঁতার কাটতে পারে। গাছের ডালেও অবস্থান নিতে পারে। বানরও গাছের ওপরে উঠতে পারে। কিন্তু হরিণ গাছে উঠতে পারে না। পানিতে দীর্ঘ সময় সাঁতারও কাটতে পারে না। এজন্য হরিণের মৃত্যু বেশি। পাশাপাশি দীর্ঘ সময় জলোচ্ছ্বাস এবং পানির উচ্চতা বেশি থাকায় বেশিরভাগ প্রাণীর মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া গাছপালার ক্ষতি তো আছেই। এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা বড় একটা চ্যালেঞ্জ। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বনকে নিজে থেকেই জাগার সুযোগ দিতে হবে। মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয় ও বনের ক্ষতি করা থেকে দূরে থাকতে হবে। প্রাণীর জন্য উঁচু কেল্লা তৈরি করতে হবে। যেন পানি বাড়লে আশ্রয় নিতে পারে। আপাতত ছোট পুকুরগুলোতে স্যালো মেশিন দিয়ে লোনা পানি বাইরে ফেলে দিতে হবে। বৃষ্টির মৌসুম আছে যেহেতু, সেহেতু সেখানে বৃষ্টির পানি জমে প্রাণীর জন্য সুপেয় পানির আধার সৃষ্টি হবে।

বন বিভাগে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে আইলার আঘাতে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার বিএম ব্যারাক, জেটি ও মসজিদ, কটকা রেস্টহাউস ও স্টাফ ব্যারাক, সুপতি ও শাপলার জেটি, অফিস ঘর, মরা ভোলার স্টাফ ব্যারাক, পানির ঘাট, ভোলা ও তেরাবেকার টহল ফাঁড়িগুলোর টিনের চাল ঝড়ে উড়ে গিয়েছিল। বগি স্টেশন সংলগ্ন সড়ক ভেঙে যায়। ডুমুরিয়া ক্যাম্প অফিস, জেটি, চরখালির স্টাফ ব্যারাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শরণখোলা রেঞ্জের অধীন ৩৬ হেক্টরের তিনটি বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনটি হরিণ ও একটি শুকরের মৃতদেহ উদ্ধার হয়।

চাঁদপাই রেঞ্জের ঢাংমারি স্টেশনের বিএম ব্যারাক, অফিস ভবন, পন্টুন, করমজলের বিএম ব্যরাক ও কুমির প্রজনন কেন্দ্রের দেয়াল ভেঙে যায়। জোয়ারা ক্যাম্পের বিএম ব্যরাক জেটি, মরা পশুর ক্যাম্প অফিস, হাড়বাড়িয়া ওয়াচ টাওয়ার ও গোল ঘরের ক্ষতি হয়। নাংলীর অফিস, ধানসাগর স্টেশন অফিস ঘর, কলমতেজিল, আমরবুনিয়া, বড়ইতলা, কাঁটাখালি, বদ্ধমারি, আন্ধারমানিক ও হরিণটানা ক্যাম্প ঘর এবং রেঞ্জ সদরের বিএম ব্যারাক ও চাঁদপাই স্টেশন অফিসের ক্ষতি হয়। এছাড়া বন বিভাগের বিভিন্ন অফিস স্টেশনে রাখা জব্দকৃত বিভিন্ন কাঠ জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায়। পাশাপাশি পশ্চিম বন বিভাগের ভেতরে সংরক্ষিত ১২টি বড় ও ১৩টি ছোট পুকুর লোনা পানিতে সয়লাব হয়। মিষ্টি পানির আধার ধ্বংস হওয়ায় বনের জীবজন্তুসহ জেলে বাওয়ালিরা, পানি ও জলের সংকটে পড়ে।

আইলার কবলে পড়ে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৬টি জেটি। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৫টি এবং ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে একটি গ্যাংওয়ে। পশ্চিম বন বিভাগের আওতায় সুন্দরবনের ৯টি স্টেশনের ৩৫টি টহল ফাঁড়ির মধ্যে ১২টি বিগত ঘূর্ণিঝড় সিডরে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেগুলো সংস্কার করার আগেই আইলার কবলে পড়ে আবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে পশ্চিম সুন্দরবনের দুটি রেঞ্জ এলাকায় ১২ হাজার ৩৩২টি গাছ ভেঙে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত এসব গাছের মধ্যে গরান গাছের সংখ্যা বেশি। যার মূল্য ১০ লাখ ১০ হাজার ৫৬০ টাকা। এছাড়া স্থাপনা, জেটি, উডেন ট্রেইল, ওয়াচ টাওয়ার ও অবকাঠামোর ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে বাঘ, হরিণসহ অন্য কোনও বন্যপ্রাণীর ক্ষতি হয়নি। এসব প্রাণী প্রকৃতি দত্ত ক্ষমতায় ঝড়ের বিষয়টি বুঝতে পেরে নিজেদের মতো আত্মরক্ষা করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর পূর্ব সুন্দরবনের দুটি রেঞ্জ এলাকায় ২৬টি গাছ ভেঙে গিয়েছিল। এই বিভাগের আওতায় জব্দ থাকা বেশ কিছু কাঠ জোয়ারের পানিতে ভেসে যায়। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় সাত লাখ ৬ হাজার ৮৩০ টাকা। পাশাপাশি পূর্ব বন বিভাগে এক কোটি ৬০ লাখ টাকার অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছিল। এবারের ক্ষতি আগের ঝড়গুলোকে ছাড়িয়ে গেছে।

সোনালী বার্তা/এমএইচ


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
এক ক্লিকে বিভাগের খবর