প্রতি বছর বাজেটে রাজস্ব আদায়ের দায় কার?
২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ কোটি টাকা, যেখানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতায় অর্থ আহরণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। তবে এনবিআরের হিসাব থেকে জানা গেছে, অর্থবছর শেষ হয়ে এলেও প্রতিবছরের মতো এবারও পূরণ হয়নি রাজস্ব আদায়ের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব আদায়ে মোট ঘাটতির পরিমাণ ২৬ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মোট ৭০ শতাংশ রাজস্ব আদায় করেছে সরকারি প্রতিষ্ঠানটি।
এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআর মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকার কম রাজস্ব আদায় করে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয় ৩ লাখ ২৫ হাজার ২৭২ দশমিক ৩৭ কোটি টাকা।
রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার ধারাবাহিকতা ছিল ২০২১-২২ অর্থবছরেও। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায় হয় ৩ লাখ ৪২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ২৮ হাজার কোটি টাকা কম।
প্রতিবছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারা এবং ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণের শরণাপন্ন হওয়ার কারণে দিনকে দিন দেশের অর্থনীতি চাপের মুখে পড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এদিকে এনবিআর বলছে, প্রতি বাজেটে এনবিআরের সক্ষমতার দিকে নজর না দিয়ে লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর কারণে চাপে পড়ছে প্রতিষ্ঠানটি।
পুরো অর্থবছরে কর বাড়ানো কিংবা নতুন করে ভ্যাট বসানোর কারণে তোপের মুখে পড়তে হয় এনবিআরকে। বাজেট আসলেই জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়, এ দায়ও গিয়ে বর্তায় এনবিআরের ওপরে। তবে দোষ কী এনবিআরের এমন প্রশ্নের জবাবে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ সময় সংবাদকে বলেন, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার ওপর ভিত্তি করে এনবিআর কর আরোপের প্রস্তাব করতে পারে। তবে সেটি গ্রহণ হবে কিনা তা নির্ভর করে সংসদের বাজেট আলোচনার ওপরে। সংসদ গ্রহণযোগ্য মনে না করলে প্রস্তাব পাস হবে না। সেখানে এনবিআরের বলার কিছু নেই।
বাজেটের দায় সংসদ সদস্যদের ওপরে উল্লেখ করে আব্দুল মজিদ বলেন, সংসদ ঠিক করবে তারা কেমন বাজেট চায়, লক্ষ্যমাত্রা কী হবে, কোথায় ভ্যাট বসানো উচিত হবে, কোথায় কর বাড়াতে হবে। এখানে এনবিআর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার ওপর ভিত্তি করে প্রস্তাব দিতে পারে। কিন্তু সেটি পাস করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব সংসদের ওপরে। সংসদ সদস্যরা যদি ভাবেন হ্যাঁ ভোট বা না ভোটের মাধ্যমে বাজেট পাস করলেই হবে, সেটি ভুল। তারা বিবেচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিক, বাস্তবতার নিরিখে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করুক।
প্রতিবছর এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া প্রসঙ্গে আব্দুল মজিদ বলেন, কীসের ভিত্তিতে প্রতিবছর এনবিআরকে এ লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় এবং লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে এনবিআর কতটুকু দায়বদ্ধ থাকে সেটি নিয়ে কাজ না করলে ফলাফল আশা করা দুরূহ। সংসদ সদস্য এমনকি মন্ত্রীরা পর্যন্ত রাজস্ব আদায় না করতে না পারলে এনবিআরকে দোষ দেন। আবার এনবিআর কর আরোপ করলে বা নতুন করে ভ্যাট বসালে সমালোচনাই করেন তারাই। এক্ষেত্রে দুই পক্ষের সমঝোতায় আসা জরুরি।
আব্দুল মজিদ বলেন, লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারায় এনবিআরকে আজ পর্যন্ত কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি। সংসদের সংশ্লিষ্ট স্থায়ী কমিটি চাইলে এনবিআরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারে। কিন্তু একদিকে কোনো জবাবদিহিতা না থাকা, অন্যদিকে প্রতিবছর নিত্যনতুন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয়ার বাস্তব ফলাফল কতখানি সেটিই এখন প্রশ্ন।
কীসের ভিত্তিতে প্রতিবছর এনবিআরকে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয় সরকার এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক সেমিনারে এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, প্রতি বছর এনবিআরকে একটি টার্গেট ঠিক করে দেয় সরকার। বছরজুড়ে এনবিআরকে অসহায়ের মতো সেই টার্গেটের পেছনে দৌড়াতে হয়। এনবিআরের সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে এ লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয় না। লক্ষ্যমাত্রা ঠিক হয় গত অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার ওপরে ভিত্তি করে।
কর আদায়ের ক্ষেত্রে এনবিআর কেন যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রহমাতুল মুনিম বলেন, যারা কর আদায়ের কথা বলেন তারাই আবার কর কমানোর কথা বলেন। সবার মানসিকতা যদি হয় কর প্রত্যাহার করতে হবে, ভ্যাট কমাতে হবে তাহলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা এনবিআরের যদি কঠিন হয়ে যাবে।
রাজস্ব আদায়ের এই লক্ষ্যমাত্রার চাপ সামলাতে গিয়ে এনবিআর অন্যকিছু ভাবতে পারছে না জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, টার্গেটের বোঝা মাথায় থাকার কারণে বুদ্ধিবৃত্তিক আইডিয়া নিয়ে কাজ করার সুযোগ পায় না এনবিআর। এই টার্গেট ঠিক করা হয় আগের বছরের টার্গেটের শতাংশের হিসাবের ওপর ভিত্তি করে। কতটুকু পূরণ করা গেল সেটি না দেখে, দিনের পর দিন রাজস্বের টার্গেট বাড়ানো হয়।
এছাড়া কর দেয়ার ক্ষেত্রে মানসিকতার প্রসঙ্গ টেনে রহমাতুল মুনিম বলেন, অটোমেশন মেশিন একা কিছুই করতে পারবে না। অটোমেশনের পেছনে যে মানুষগুলো বসে আছে, তারা ঠিক হয়নি। প্রতিটি মানুষকে ধরে ধরে শুদ্ধ করা এনবিআরের পক্ষে সম্ভব না। তবে আয়কর ও ভ্যাট যদি বাড়াতে হয়, তাহলে অটোমেশনের কোনো বিকল্প নেই। দারোগা-পুলিশ দিয়ে ধরে ধরে কর আদায় করা সম্ভব না।
প্রতিবছর প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে এনবিআরকে চাপ দেয়া হলেও এক্ষেত্রে আশানুরূপ ফল করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে কর প্রদানে মানুষের অনীহার প্রসঙ্গ টেনে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান বলেন, শুধু বেসরকারি বা করপোরেট প্রতিষ্ঠান না, অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত কর দিতে চায় না। যাতে করে কর দিতে না হয় সেজন্য প্রতিনিয়ত এনবিআরের বিভিন্ন পক্ষ থেকে তদবিরের আবেদন আসতে থাকে।
এনবিআরের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব আছে কিনা এবং কর আদায়ের ক্ষেত্রে এনবিআরকে সরকার কী ধরনের সাহায্য করতে পারে এ প্রসঙ্গে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, সরকারের সঙ্গে এনবিআরের কোনো দূরত্ব নেই। এনবিআরের সঙ্গে এক টেবিলে বসে বারবার আলোচনার মানেই হচ্ছে সরকারও চায় এনবিআরকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে। কাঠামোগত ও নীতিগত সহযোগিতার মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয় এনবিআরকে আরও শক্তিশালী করবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
সোনালী বার্তা/এমএইচ