শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২৫, ০৬:৩১ অপরাহ্ন

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্যের লড়াই, ৬ মাসে ২৬ নেতা খুন

নিজস্ব প্রতিবেদক / ১২১ Time View
Update : বৃহস্পতিবার, ২০ জুন, ২০২৪

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গাদের মধ্যে সহিংসতা বেড়েই চলেছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাত ধরেই ক্যাম্পগুলোতে অত্যাধুনিকসহ বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকছে। ফলে বেড়েছে প্রাণহানির ঘটনা। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও ভয়ে-আতঙ্কে রয়েছেন।

এদিকে আজ ২০ জুন পালিত হচ্ছে বিশ্ব শরণার্থী দিবস। ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভার বহন করছে বাংলাদেশ। তবে আজকের দিনটি পালন করতে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে এবার কোনও ধরনের আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা নেতারা।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত ক্যাম্পগুলোতে ২৬ রোহিঙ্গা নেতার মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্য চার জন ক্যাম্পে স্বেচ্ছায় ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করছিলেন। মূলত রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যার পরই ক্যাম্পে নিজেদের নিরাপত্তায় তারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়োজিত হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, শিবিরে প্রায় এক ডজন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। এদের মধ্যে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্যরা প্রায়ই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ জড়িয়ে পড়ছে।

৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (এডিআইজি) মো. আমির জাফর জানিয়েছেন, শরণার্থী শিবিরে হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঠেকাতে জেলা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে যৌথ টহল জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া ক্যাম্পগুলোতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরি করে তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

বাড়ছে সহিংসতা

পুলিশ ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) তথ্য মতে, শরণার্থী শিবিরে চাঁদাবাজি ও মাদক চোরাচালানকে ঘিরে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে হামলা, সংঘর্ষ ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটছে। এতে চলতি বছরের শুরু থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত চার জন কমিউনিটি নেতাসহ ২৬ রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়েছেন। ২০২৩ সালে হত্যার শিকার হন ৬৪ জন। এর আগে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরে ১৩২টি হত্যাকাণ্ড ঘটে। হত্যার শিকার অধিকাংশই ছিলেন রোহিঙ্গা নেতা বা মাঝি।

সর্বশেষ গত ১৪ মে উখিয়ার একটি শিবিরের হেড মাঝি মোহাম্মদ ইলিয়াসকে (৪৩) ঘর থেকে তুলে নিয়ে গুলি করে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে আরসার বিরুদ্ধে। এর আগে ৬ মে উখিয়ার বালুখালী শিবিরে রোহিঙ্গা নেতা জাফর আহমদকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গুলি করে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ধারণা করা হচ্ছে, সেই হত্যাকাণ্ডেও আরসা জড়িত। তার আগের দিন বালুখালীর রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন (আরএসও) সদস্য নুর কামালকে গলা কেটে হত্যা করা হয়।

উখিয়া বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা নুর হোসাইন বলেন, ক্যাম্পে হঠাৎ ফের সন্ত্রাসীদের আনাগোনা চোখে পরার মতো বেড়েছে। যার কারণে ক্যাম্পে মারামারি-খুনখারাবির ঘটনা বাড়ছে। মূলত আরসা-আরএসও’র মধ্য আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গোলাগুলির ঘটনা প্রতি রাতেই ঘটছে। তাদের দ্বন্দ্বের কারণে অনেক সময় সাধারণ রোহিঙ্গারা মারা যাচ্ছে।

সংঘাত কেন?

বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা মাঝি জানান, শিবিরের সব জায়গায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তারা নিজেদের কৌশল পরিবর্তন করেছে। এখন আর আগের মতো দল বেঁধে অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে চলাফেরা করে না তারা। কাউকে টার্গেট করলে সুবিধামতো সময়ে হামলা করে।

কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নেতা মোহাম্মদ আমিন বলেন, কোনও একটি সশস্ত্র গ্রুপ একটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আরেকটি গ্রুপ পাল্টা হামলা করে সেই এলাকার দখল নেওয়ার চেষ্টা করে। মূলত ক্যাম্পে ফের আরসা-আরএসও’র মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যা বাড়ছে। এছাড়া মিয়ানমারের চলমান যুদ্ধে অংশ নিতে ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের পাঠানো নিয়েও এদের মধ্যে সংঘাত হচ্ছে।

উখিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ শামিম বলেন, ক্যাম্পে মাঝি (রোহিঙ্গা নেতা) ও স্বেচ্ছাসেবীদের কারণে অপরাধীদের কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়। তাই অনেক সময় ক্ষিপ্ত হয়ে সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। এছাড়া ক্যাম্পে নতুন করে সন্ত্রাসীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। কোনও সন্ত্রাসী দলকে আমরা এখানে ঠাঁই হতে দেবো না। পাশাপাশি ক্যাম্প এলাকায় টহল এবং নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

মিয়ানমারের চলমান যুদ্ধে রোহিঙ্গারা অংশ নেওয়ার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে ক্যাম্পে গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে বলে শুনেছেন উখিয়ার পালংখালি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ক্যাম্পগুলোতে এখন প্রধান ৪-৫টি সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় আছে। তাদের মধ্যে ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ ও মাদক বিশেষ করে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ে ব্যাপক দ্বন্দ্ব রয়েছে। যার ফলে ক্যাম্পের সাধারণ মানুষসহ স্থানীয় লোকজন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
এছাড়া ক্যাম্পে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা রাতের বেলার স্থানীয় বসতিদের গ্রামে ঘোরাঘুরি করছে। এতে আমাদের জীবন নিয়ে আমরা খুব শঙ্কিত। তাই সরকারের কাছে দাবি, এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল জোরদার করা হোক।

আরকান রোহিঙ্গা আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মুহাম্মদ জোবায়ের বলেন, আসলে আমাদের জীবন গন্তব্যহীন, একূল-ওকূল কিছুই নেই। ক্যাম্পে দিন দিন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। বিশেষ করে নারী-শিশুদের নিয়ে আমরা খুব চিন্তিত। থাকা-খাওয়ার নেই তেমন কোনও অবস্থা। দিন দিন হত্যার মতো ঘটনা বাড়ছে, তাই এখানে জীবনের নিরাপত্তা নিয়েই প্রতিনিয়ত চিন্তার মধ্য থাকতে হয়।

সোনালী বার্তা/এমএইচ


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
এক ক্লিকে বিভাগের খবর