শহীদের সন্তান হিসেবে আওয়ামী লীগের কাছে প্রত্যাশা
শহীদের সন্তান হিসেবে আমি সবসময় আওয়ামী লীগের কাছে প্রত্যাশা রাখতে চাই। আমাদের মতো পরিবারগুলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অপূরণীয় ক্ষতি নিয়ে জীবন যাত্রার সংগ্রামে লড়াই করে বেঁচে থাকে, প্রত্যাশা নিয়েই। আমরা হাল ছাড়ি না, রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলাদেশ, শোকের পাহাড় পেরিয়ে শক্তিশালী এক অসাম্প্রদায়িক দেশের উদাহরণ হয়ে থাকবে তার জন্য।
২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে যেহেতু আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় এসেছে তাই আমাদের প্রত্যাশা অবিকল একই থাকবে। হয়তোবা আমরাই শেষ প্রজন্ম যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শিরায় শিরায় ধারণ করি। তাই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য যে স্তম্ভগুলোয় ভর করে গণযুদ্ধে সামিল হয়েছিল, তাদের অস্বীকার বা ম্লান করার পন্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো না কখনোই, কোনোদিনও।
এবারের নির্বাচনে আবারও এমপিদের মাঝে দুই তৃতীয়াংশ স্থান দখল করে নিয়েছে ব্যবসায়ীরা। রাজনৈতিক উঠানে যখন ব্যবসায়ীদের দাপট থাকে, সেইখানে তৃণমূলে কাজ হয় কম। এই শঙ্কা গভীর হয়, আমার মতো শহীদ সন্তানের স্বদেশ ভাবনার চেতনায়।
খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, নারী অধিকার, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে সব নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য রাজনৈতিক নেতারা যেভাবে কাজ করেন, তা ব্যবসায়ী রাজনৈতিক নেতা থেকে আশা করাটা বোকামি।
ইসলাম ও জামায়াতকে সাধারণ জনগণ পরিপূরক বা সমার্থক ভাবতে শুরু করে দিয়েছে। অসাম্প্রদায়িক সমাজের বীজ নষ্ট হয়ে গেছে শিক্ষায় জামাতিকরণের হাত ধরে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষা আন্দোলন একজন বাংলাদেশি নাগরিকের অস্তিত্ব এবং পরিচয় বহন করে। এসব থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদেরও।
রাজনীতি সচেতন মানুষকে আওয়ামী পন্থী বা লীগের দালাল নামে কটাক্ষ করার এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। ইসলাম পরিপন্থী ব্যতীত আর কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের দল মাঠে না থাকায়, রাজনৈতিক সচেতনতাকে ইসলাম বিরোধী, নাস্তিক, দালাল নামে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
কিছু মানুষ আছে যারা আওয়ামী লীগের মতাদর্শে বিশ্বাসী নয়, তারা সুযোগ সন্ধানী দল। ওদের মতো সহসা লীগ ভক্তরা এই আলোচনা বা সমালোচনাকে সরকার বিরোধী বক্তব্য বলে দাঁড় করিয়ে দেয়।
বাঙালির আদি ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতিকে শরিয়ত বিরোধী বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। অথচ ‘শরিয়ত কী’ জিজ্ঞেস করলে তা আর বলতে পারে না কেউ। সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় যখন কেউ রাজনীতি বা সরকার সম্পর্কে ভালো বা মন্দ বা আলোচনা সমালোচনা করে। কারণ কিছু মানুষ আছে যারা আওয়ামী লীগের মতাদর্শে বিশ্বাসী নয়, তারা সুযোগ সন্ধানী দল। ওদের মতো সহসা লীগ ভক্তরা এই আলোচনা বা সমালোচনাকে সরকার বিরোধী বক্তব্য বলে দাঁড় করিয়ে দেয়। মুক্তমনা নাগরিকের মুখ চুপ করিয়ে দেওয়াই এদের আসল উদ্দেশ্য।
শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং অসাম্প্রদায়িকতা একটির সাথে আরেকটি বিনুনি গাঁথা। সেই সাথে পারিবারিক বা সামাজিক সুস্থ পরিবেশ, ধর্ম, নারী-পুরুষ সমতা, স্বাস্থ্য, খাদ্য সেই বিনুনির পৃথক পৃথক শাখার মতো একে অপরের সাথে জড়িয়ে থাকে।
একটি শিশুকে নিজ অস্তিত্ব জানানোর জন্য পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় সঠিক নির্দেশনা অত্যন্ত জরুরি। আমরা একে অপরকে দোষারোপ করেই আগামীর পথচলাকে ধীর করে তুলেছি। আগামী প্রজন্মকে দেশ, ভাষা, মুক্তিযুদ্ধ জানানোর জন্য তৃণমূলে কাজ কম করেছি এবং এই শূন্যতার জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে অল্প শিক্ষিত ধর্ম ব্যবসায়ীরা। সাম্প্রদায়িক বীজ বপন করে চলেছে অবিরত।
আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা বদলে গেছে শুধুমাত্র এই সব কারণে। ধর্মনিরপেক্ষতা মানেই ইসলাম বিরোধী, এই ভাবনাটি শক্ত করে বসানো হয়ে গেছে তৃণমূলে। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পাওয়ার লড়াইটির ইতিহাস আবছা হয়ে এসেছে।
বাংলাদেশ বলতেই স্বাধীন নাগরিক তার নিজ ভাষা, পরিচয়, সংস্কৃতি, আচার, উপাচার, ধর্ম পালনে অবাধ সুযোগ পাওয়ার কথা ছিল। অথচ আজ সংখ্যালঘু হয়ে গেছে ইসলাম ব্যতীত ‘অন্য সব ধর্ম’। আদিবাসীরা বিতাড়িত হয়ে যাচ্ছে নিজ বাসস্থান থেকে। হারিয়ে গেছে অজস্র আদিবাসী ভাষা।
আগামী প্রজন্মকে দেশ, ভাষা, মুক্তিযুদ্ধ জানানোর জন্য তৃণমূলে কাজ কম করেছি এবং এই শূন্যতার জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে অল্প শিক্ষিত ধর্ম ব্যবসায়ীরা। সাম্প্রদায়িক বীজ বপন করে চলেছে অবিরত।
গরিষ্ঠ সংখ্যক মুসলিমের দেশে সংখ্যালঘু হয়ে বেঁচে থাকাটাই যেন যন্ত্রণা, এমন কি প্রত্যাশা ছিল? সংখ্যালঘু হিসেবে আখ্যা পাওয়ার জন্য সব ধর্মের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন?
তারা মিলেমিশে জাতির পিতার আহ্বানে, আর সবার সাথে এক হয়ে থাকার জন্যই যার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক বীজ উৎপাটনে সদা জাগ্রত থাকার এখনই সময়।
ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের গৌরব এনে দেওয়া আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কখনোই নেতিবাচক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তার মতাদর্শ অত্যন্ত স্বচ্ছ ছিল। যে কারণে দেশের প্রতিটি স্তরের মানুষ তার পেছনে থেকে, দেশ ও দশের ভালোর জন্য লড়াই করতে একটুও দ্বিধাবোধ করেনি।
জাতির পিতা সব ধরনের ইতিবাচক রাজনৈতিক মতাদর্শকে সাথে নিয়েই রাজপথে হেঁটেছেন। সবার আগে দেশ—এই নীতিতে নিজ পরিবারসহ নির্মম হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং সেই সময় থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের তৎপরতা আবারও জেগে উঠেছিল এই মাটিতে।
তারা কখনো ভাবেনি যে বাংলাদেশ আবারও একাত্তরে বীজমন্ত্রে জাগ্রত হয়ে উঠবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং রায় হবে। বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সময় শেষ হবে।
সত্যিকার অর্থে সৌভাগ্যক্রমে তার উত্তরসূরি হিসেবে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বেঁচে গিয়েছিলেন বলেই আজও আমরা প্রত্যাশা করি। কন্যাদ্বয়ের শিরায় শিরায় জাতির পিতার রক্ত বহমান।
লাখো মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে এই সোনার বাংলা, স্বাধীনতা বিরোধী শকুনেরা বারবার আক্রমণে জর্জরিত করতে চাইলেও, আমরা শক্ত হাতে তা রুখে দেওয়ার শক্তি পাই। কারণ আমরা জানি আমাদের জন্য জাতির পিতা ছায়া হয়ে আছেন। তিনি আমাদের যে জাতির সাথে পরিচয় করিয়ে গিয়েছিলেন, সেই লাল সবুজের পরিচয় নিয়ে সবাই মিলে স্বাধীনতা উপভোগ করার প্রত্যাশা করি।
জানি, আমার মতো শত শত পরিবার প্রত্যাশা করে, তাদের জন্য একটি খোলা দরজা আছে বলেই হাল ছাড়ে না সহজে। আমরা কখনোই বলতে পারি না যে, এই দেশ আমার নয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সমুজ্জ্বল রাখার সর্বান্তকরণ চেষ্টা, বঙ্গবন্ধু কন্যাদ্বয় করে যাচ্ছেন ক্রমাগত, সেই বিশ্বাসে অবিরাম জাগ্রত কোটি বাঙালি। সেই বিশ্বাসের প্রতিফলন দেখতে চাই আমরা।
লেখক : শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা
সোনালী বার্তা/এমএইচ