ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আ.লীগে কোন্দল থামছেই না
- শীর্ষ দুই নেতার দ্বন্দ্ব এখন ‘ওপেন সিক্রেট’
- জমা দেয়া হয়েছে পৃথক পৃথক দুটি প্রস্তাবিত কমিটি
- নতুন করে প্রস্তাবিত কমিটি জমা দেওয়ার নির্দেশ
- মহানগর নেতৃবৃন্দের প্রতি ক্ষুব্ধ কেন্দ্রীয় নেতারা
- আলোচনা হয়নি ঢাকার সংসদ সদস্যদের সাথেও
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও কমিটি গঠনকে ঘিরে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগে দলীয় কোন্দল যেন কোনোভাবে থামছেই না। সংগঠনটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বয়ে চলা ‘নিবর দ্বন্দ্ব’ এখন প্রকাশ্যে রুপ নিচ্ছে। ফলে ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ২৪টি থানা ও ৭৫টি ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত কমিটি ঘিরে তাদের দ্বন্দ্ব যেন এখন ‘ওপেন সিক্রেট’।
সম্প্রতি সংগঠনের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী ও সাধারণ সম্পাদক মো: হুমায়ুন কবির; দুটি কমিটির প্রস্তাবিত তালিকা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে জমা দিয়েছেন। তবে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এক সঙ্গে কমিটির জন্য প্রস্তাবিত তালিকা জমা দিলেও তারা মূলত যৌথ স্বাক্ষরে প্রস্তাবিত কমিটি জমা দেননি।
অভিযোগ উঠেছে, ঢাকা মহানগরের মধ্যে থাকা ঢাকার সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্য এবং সিটি করপোরেশনের মেয়রের সঙ্গেও কোনো প্রকার কোনো ধরণের আলাপ-আলোচনা কিংবা পরামর্শ ছাড়াই বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড কমিটির প্রস্তাবিত তালিকা জমা দেয়া হয়েছে। এতে ঢাকার নির্বাচিত সংসদ সদস্যসহ কেন্দ্রীয় নেতারাও ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
যার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ জুন আওয়ামী লীগের ৭৫ তম প্লাটিনাম জুবিলি’ উপলক্ষে রাজধানীর রোজগার্ডেনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এক পর্যায়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন ওবায়দুল কাদের। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী ও সাধারণ সম্পাদক মো: হুমায়ুন কবিরকে উদ্দেশ্য করে সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে বলতে শোনা গেছে; ‘আপনারা কী কমিটি জমা দিয়েছেন? দুই জন এক সঙ্গে বসে ঠিকঠাক করে নতুন ভাবে কমিটি জমা দেন।
এখানেই শেষ নয়; গত শনিবার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭৫তম ‘প্লাটিনাম জুবিলি’ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনাসভার মঞ্চেও কে কে বক্তব্যে রাখবেন এই নিয়ে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে একে অপরের সঙ্গে তর্ক-বির্তকে জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। এক পর্যায়ে আলোচনাসভা পরিচালনার দায়িত্বপালন করা সংগঠনের প্রচার সম্পাদকের দিকে এক রকম ত্যাড়ে এগিয়ে যেতে দেখা যায় সাধারণ সম্পাদক মো: হুমায়ুন কবিরকে। অনেকটাই ধমকের সুরে সাধারণ সম্পাদককে কথা বলতে শোনা যায়; কে কখন বক্তব্যে দেবে সেটা আমাকে জিজ্ঞাসা না করে নাম ঘোষণা করা হচ্ছে কেন? তখন পাশেই বসে থাকা সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ুন কবিরকে উদ্দেশ্য করে বললেন; ত্যাড়ে আসলেন কেন? মারবেন নাকি? প্রতি উত্তরে হুমায়ুন কবিরকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনি বলার কে? তখন আবু আহমেদ মন্নাফী বলেন, আমি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি।
জবাবে হুমায়ুন কবিরও বলেন, আমিও সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। কাজেই আমার কথায় চলবে সংগঠনের কার্যক্রম। এ সময় উভয়ের কথাবার্তা কয়েকমিনিট আক্রমণাত্মক তর্কে জড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উভয়কে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এবং আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য সাঈদ খোকনের দুই পাশে বসতে দেখা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের থানা ও ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত কমিটি কেন্দ্রে জমার পর থেকে পদপ্রত্যাশীদের কেউ কেউ কেন্দ্রে চিঠি দিয়েও অভিযোগ জানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, কমিটিতে ‘মাই ম্যান’ তৈরিতে নিজের বলয় শক্তিশালী করার জন্য পরিবার ও স্বজনরা সম্পর্কের কারণে এবং অন্যরা ‘বিপুল’ অর্থ বিনিয়োগ করে পদ পেতে যাচ্ছেন। যদিও মহানগরের দায়িত্বশীল নেতারা এ সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, কমিটি যথাযথভাবে দিয়েছেন। বাকি সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী সোনালী বার্তাকে বলেন, জমা দেয়া প্রস্তাবিত কমিটি কবে ঘোষণা হবে সেটি কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের বিষয়। আমি যতটুকু সম্ভব যারা আওয়ামী লীগ ও দেশের জন্য আওয়ামী লীগ করে থাকেন। যারা হাইব্রিড আওয়ামী লীগ না; তাদেরকে যাচাই-বাছাই করে প্রস্তাবিত কমিটিতে নাম অর্ন্তভুক্ত করেছি। যদিও কেউ (সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের প্রতি ইঙ্গিত করে) আবার আওয়ামী লীগের বাইরে সুবিধাভোগী ও হাইব্রিড আওয়ামী লীগকে কমিটিতে অর্ন্তভুক্ত করতে চাচ্ছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কমিটি দেয়া সহজ নয়। আওয়ামী লীগ একটি প্রাচীন রাজনৈতিক দল যার হাত ধরে দাড়িয়ে আছে আজকের বাংলাদেশ। কমিটিতে আসার মতো অনেকযোগ্য নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে রয়েছে তারপরও একটি নিদিষ্ট সীমায় কমিটি করা হয় তাই চাইলেও সব যোগ্যদের কমিটিতে রাখা যায় না। তবে আমি চেষ্টা করেছি যোগ্য ও দলের জন্য নিবেদিতদের কমিটিতে নিয়ে আসতে। সেক্ষেত্রে অন্যজন কি করেছেন; না করেছেন জানি না।
আমি প্রস্তাবিত কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ঢাকার সংসদ সদস্যদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করে তালিকা প্রস্তুত করেছি। কথা বলেছি সাবের হোসেন চৌধুরী, আওলাদ হোসেন, মশিউর রহমান মোল্লা সজলের সঙ্গে। সাঈদ খোকনকে ভাতিজা বলে ডাকি; সেও আমাকে বলেছেন, চাচা আপনি অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ আপনি যা ভালো মনে করেন তা অবশ্যই আওয়ামী লীগের জন্য মঙ্গলজনক হবে। যারা মাঠে ছিলেন, তুলনামূলকভাবে জনপ্রিয় ও ত্যাগী- তাদের নাম কমিটিতে প্রস্তাব করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতারা যাছাই করে যেটা করবেন তাতে আপত্তি নেই। তাছাড়া দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র তাপস সাহেব (ফজলে নুর তাপস) তিনিও কিছু অর্ন্তভুক্ত করেছেন। কাজেই উনার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলার প্রয়োজন হয়নি।
কমিটির প্রস্তাবিত তালিকা জমার পূর্বে ঢাকার সংসদ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা পরামর্শ নিয়েছেন কি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক? এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা-৫ (ডেমরা-যাত্রাবাড়ী) সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্য মশিউর রহমান মোল্লা সজল সোনালী বার্তাকে বলেন, ‘আমার সঙ্গে কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা করা হয়নি। আর এখন কমিটিতে কারা কারা আসতে পারে বলে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে; তাদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হলে দল সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে।
যেমন আমি নিজে ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, এখন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। এর বাইরেও এলাকায় পারিবারিকভাবে দলের প্রতিটি সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সখ্যতা আছে সর্ম্পক আছে। তাই দলীয় প্রতিটি কর্মসূচিতে ব্যাপক উপস্থিতি থাকে নেতাকর্মীদের। কিন্তু প্রস্তাবিত কমিটিতে যদি ত্যাগীদের সেভাবে মূল্যায়ণ করা না হয়; তাহলে ভবিষ্যতে কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি কতদিন ধরে রাখা যাবে নিশ্চিত করে বলা যায় না।
তিনি বলেন, ‘বেশকিছুদিন পূর্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের; আমি উনাকে চাচা বলি। চাচা- ঢাকার সংসদীয় আসনগুলো থেকে নিবার্চিত সংসদ সদস্য ও সিটি মেয়রদের ডেকে বৈঠক করেছিলেন। উদ্দেশ্য যদিও ছিল আওয়ামী লীগের ৭৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আয়োজন ঘিরে কিন্তু সেখানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতে কিছু কথা তুলে ধরেছিলেন সংসদ সদস্যরা। আলোচনায় মহানগরের কমিটি নিয়েও কিছু কথা উঠে আসে। তাই আলোচনা কিংবা পরামর্শ যাই বলেন না কেন; এখন প্রস্তাবিত কমিটির তালিকা জমা দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ করেনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতৃবৃন্দ।’
এদিকে ঢাকা-৬ সংসদীয় আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য সাঈদ খোকন সোনালী বার্তাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের মুখপাত্র আছেন; উনার সঙ্গে কথা বলুন; বিষয়টি উনিই ভালো বলতে পারবেন।’
জানতে চাইলে ঢাকা-৪(শ্যামপুর-কদমতলি) আসনের সংসদ সদস্য মো: আওলাদ হোসেন সোনালী বার্তাকে বলেন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত কমিটির ক্ষেত্রে আমার সঙ্গে কোন প্রকার যোগাযোগ করেননি সংগঠনটির শীর্ষ দুই নেতা। শুধু আমি নই, তারা ঢাকা থেকে নির্বাচিত কোনো সংসদ সদস্যের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলেননি, কথা বলার প্রয়োজন মনে করেননি। তাই আমরা সংসদ সদস্যরা এই বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে অবহিত করেছি।
তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করি। আমরা জানি কে ভালো কে মন্দ। প্রস্তাবিত কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গেও কথা বলার প্রয়োজন মনে করেনি মহানগরের শীর্ষ দুই নেতা। কিসের ভিত্তিতে কাকে নেতা বানাতে চাচ্ছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন। মূলত তারা নেতা হোক তাদের চাচ্ছেন যারা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পদকের ছবি দিয়ে পোস্টার ফেস্টুন টাঙিয়েছেন। যতটুকু শোনতে পাচ্ছি প্রস্তাবিত কমিটির তালিকায় মাঠের নেতাদের নাম আসে নাই।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে কথা হয়েছে বলে তারা (সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক) যে কথা বলছেন সেটি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা।
তবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো: হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে একাধিকভাবে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোনকল রিসিভ করেননি।
সোনালী বার্তা/এমএইচ
ভেঙ্গে দেয়া হোক মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের এই ব্যর্থ কমিটি।নতুন করে দেয়া মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কমিটি। অবিলম্বে সম্মেলন দেয়া উচিত।