সুনামগঞ্জে বন্যা হলেই সড়ক ভাঙে
হাওড়ের পরিবেশ প্রকৃতি পানি প্রবাহ বিবেচনায় না নিয়ে সড়ক অবকাঠামো নির্মাণের ফলে বারবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় সুনামগঞ্জের বিভিন্ন সড়ক। সড়ক নির্মাণের ডিজাইন করা হয় ঢাকায় বসে আর বাস্তবায়ন করা হয় হাওড়ে। এভাবে কাজ করায় প্রতি বছর সরকারের কোটি কোটি টাকা বানের পানিতে ভেসে যায়।
বৃষ্টি-বন্যাপ্রবণ সুনামগঞ্জে বিটুমিনের সড়ক নির্মাণ করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। বিটুমিনের শত্রু পানি; টানা বৃষ্টিতে বিটুমিনের সড়ক প্রথমেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাওড়ের নিচু এলাকায় সরকারি সংস্থাগুলো বিটুমিনের সড়ক নির্মাণ করায় তা সরকারি টাকার অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। প্রতিটি সড়কে পানি প্রবাহে পর্যাপ্ত সেতু কালভার্ট নেই, তাই পাহাড়ি ঢলের পানিতে সড়কের নিচু অংশ বারবার বিধ্বস্ত হয়। এজন্য জনদুর্ভোগ বাড়ে, সরকারি টাকা নষ্ট হয়। সুনামগঞ্জে বিটুমিনের সড়ক নির্মাণ বন্ধ করা উচিৎ।
পরিবেশবাদী সংগঠন হাউসের নির্বাহী পরিচালক সালেহীন চৌধুরী সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণগুলো এভাবেই ব্যাখ্যা করেন।
হাওড় বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুনামগঞ্জে আগের চেয়ে বৃষ্টিপাত বেশি হয়। উজানেও বৃষ্টিপাত বেশি হয়। মেঘালয়ের পানি চলতি যাদুকাটা, চেলা পিয়াইন, সুমেশ্বরী, রক্তি পাটলাইসহ ৭ টি সীমান্ত নদী দিয়ে দ্রুত চলে আসে। পাহাড়ে বৃষ্টি হলেই সুনামগঞ্জ পানিতে সয়লাব হয়ে যায়।
একঘণ্টার ব্যবধানে ঢলের পানি সুনামগঞ্জে চলে আসে। প্রতিবছর বানের পানিতে সড়ক সেতু কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি নিয়মিত ঘটনা। প্রতি বছর এরকমটি ঘটার পরেও সুনামগঞ্জে বিটুমিনের সড়ক নির্মাণ করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেশি লাভ করার জন্য নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়। এজন্য সড়কের বেশি ক্ষতিসাধন হয়।
সড়ক ও জনপথের তথ্য অনুযায়ী, এবারের বন্যায় সিলেট সুনামগঞ্জ সড়ক, সুনামগঞ্জ কাচিরগাতি বিশ্বম্ভরপুর সড়ক, জামালগঞ্জ-সুনামগঞ্জ সড়ক, গোবিন্দগঞ্জ ছাতক দোয়ারাবাজার সড়ক, নিয়ামতপুর-তাহিরপুর সড়ক, মদনপুর-দিরাই শাল্লা সড়ক, দোয়ারাবাজার-সুনামগঞ্জ সড়ক, পাগলা জগন্নাথপুর রানীগঞ্জ আউসকান্দি সড়কের ৯৬ কিলোমিটার জায়গা বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এসব সড়কে ওয়াশ আউট, পেভমেন্টের ধার ভেঙে যাওয়া, পেভমেন্টের বিটুমিনাস সার্ফেস উঠে যাওয়া, সড়কে পটহোলস, আনডুলেশন, ডিপ্রেশন, সড়কের সোল্ডার ধসে যাওয়া, সেতু কালর্ভার্টেও অ্যাপ্রোচ ধসে যাওয়াসহ বিভিন্ন রকমের ক্ষতি হয়েছে। এসব সড়ক স্বল্প মেয়াদে মেরামতের জন্য ১৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা ও দীর্ঘমেয়াদি মেরামতের জন্য ২৫০ কোটি টাকা লাগবে বলে জানায় জেলা সড়ক ও জনপথ।
অন্যদিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর জানায়, ৫০ টি সড়কের সম্পূর্ণ ভাসিয়ে নিয়েছে ২৫ টি জায়গা। এছাড়া সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ২০ সেতু ও কালভার্ট এবং ৬০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে গেছে। এতে তাদের ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বিটুমিনের সড়ক সংস্কার মেরামত ও সংরক্ষণ করা সহজ। পক্ষান্তরে আরসিসি বা কংক্রিটের সড়ক মেরামত করা সহজ নয়। এটি ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ। কংক্রিটের সড়ক সংস্কার করতে হলে অনেক খরচ হয়। তবে সেখানে পানির চাপ বেশি সেখানে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণ করা উচিৎ। কংক্রিটের সড়কের ওপর দিয়ে পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবাহিত হলে কোনো ক্ষতি হয় না। পানি নেমে যাওয়ার পরপর সড়কটি যান চলাচলের উপযোগী হয়ে ওঠে।
এদিকে সড়ক জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম প্রমাণিক বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক ও বিশ্বম্ভরপুর কাচিগাতি সড়কের নিচু অংশ কংক্রিট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এগুলো এখনও ভালো আছে। সরকারের উচ্চ মহল চাইলে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণ করা সম্ভব।
পরিবেশ ও হাওড় উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাশমির রেজা বলেন, ‘সুনামগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ নষ্ট হওয়ার মূলে রয়েছেন ইঞ্জিনিয়াররা। হাওড়ের পরিবেশ প্রকৃতি আমলে না নিয়ে গৎবাধা নিয়মে হাওড়ের নিচু এলাকায় বিটুমিনের সড়ক তৈরি করে। তাই প্রতিবছর পাহাড়ি ঢলে সড়ক নষ্ট হয়। পানির প্রবল স্রোতে বিটুমিনের সড়ক টিকতে পারে না, দ্রুত ভেসে যায়। কংক্রিটের সড়কের ওপর দিয়ে পাহাড়ি ঢল প্রবাহিত হলেও সড়কের ক্ষতি হয় না।
পানি নেমে যাওয়ার পর সড়কে মানুষ যানবাহন চলাচল করে। হাওড় এলাকার পরিবেশ প্রকৃতি পানি প্রবাহ বিবেচনা রেখে সড়ক বানাতে হবে। ঢাকার এসি রুমে বসে হাওড় এলাকার সড়কের ডিজাইন করলে এমনটি ঘটতেই থাকবে। ইঞ্জিনিয়াররা সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে স্থানীয়দের মতামত নেন না, নিলে আরও ভালো হতো। বিটুমিনের সড়ক তৈরি করে সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় হয়, মানুষের কষ্ট বাড়ে। এটি যুগের পর যুগ ধরে চলছে। কিন্তু কেউ সংশোধনের উদ্যোগ নেয় না। পানি প্রবাহ বন্ধ করে সড়কে ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়ানো হচ্ছে।
সোনালী বার্তা/এমএইচ