পদ্মার চরে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে আঙ্গুলে পচন কৃষক আলমের
রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় পদ্মা নদীর চরে বাদাম খেতে কাজের সময় রাসেলস ভাইপার সাপে কামড় দেয় আলম বিশ্বাসকে (৫৫)। এই ঘটনা এক বছর অতিবাহিত হলেও এখনও পরিপূর্ণ সুস্থ হতে পারেননি তিনি। সাপে কামড়নো হাতের আঙ্গুলে পচন ধরার পরে বর্তমানে অস্বাভাবিক অবস্থায় রয়ে গেছে। তাই আলম বিশ্বাসকে এক হাতে সারতে হয় যাবতীয় কাজ।
বাঘা উপজেলার পদ্মার মধ্যে চকরাজাপুর ইউনিয়নের কালিদাসখালী চরে কথা হয় আলম বিশ্বাসের সাথে। তিনি বাড়িতে লালন-পালন করা দুটি গরুকে ধানের খড় খেতে দিচ্ছিলেন। সেই কাজগুলো আলম বিশ্বাস ডান হাতে করছিলেন। আর বাম হাত আলতো করে গরু বাধা বাঁশের খুঁটির উপরে রেখেছিলেন।
তার দাবি-‘সাপে কামড়ানো আঙ্গুল এখনও ব্যাথা করে। হালকা আঘাতেই রক্ত ঝরে। কোনো দিন ভাবিনি, যে আঙ্গুলের এই অবস্থা হবে।’
সাপে কামড়ানোর ঘটনার দিনে বর্ণনায় আলম বিশ্বাস বলেন, ২০২৩ সালের ৪ জুলাই রাসেলস ভাইপার সাপে কামড় দিয়ে ছিল পদ্মার চরের বাদামের জমিতে কাজের সময়। সেদিন ১৬ জন শ্রমিক নিয়ে খেতের আগাছা পরিস্কার করতে গিয়েছিলাম।
সাপ আগে থেকে ছিল। কিন্তু দেখিনি। আগাছা পরিস্কারের জন্য বাম হাত বাড়িয়েছি আর সাপে আঙ্গুলে কামড় দেয়। তখন হাতের উপরে রশি দিয়ে শক্ত করে বাধন দেওয়া হয়। তখন লোকজন মিলে জীবিত সাপ ধরা হয়। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের চিকিৎসকরাও বলেছিল রাসেলস ভাইপার সাপে তাকে কামড় দিয়েছে।
চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সাড়ে ৫ মাস চিকিৎসা নিয়েছি। রাজশাহী ও ঢাকায় মেডিকেলে চিকিৎসা ছাড়াও বাঘা ও কুষ্টিয়া ওঝার কাছে চিকিৎসা নিয়েছি। তবুও এখনও পুরো সুস্থ হতে পারিনি। এখনও সাপের বিষের ব্যাথা আছে আঙ্গুলে। আমার সাহস ছিল, আর আল্লাহ হায়াত দিয়েছিল বলে বেঁচেছি। এবারও পদ্মার চরে ১৭ বিঘা জমিতে বাদামের চাষ করেছি। নদীতে বানের (বন্যা) পানি ঢুকে যাওয়ায় ৯ থেকে ১০ বিঘা জমির বাদাম তোলা হয়নি। শুধু সাপের ভয়ে পানিতে বাদাম তুলতে নিজে যায়নি। সাপের ভয়ে শ্রমিকও যায়নি। সেগুলো এখন পানিতে তলিয়ে গেছে।
এখনও সুস্থ হতে পারেন দাবি করে আলম বিশ্বাস বলেন, সাপে কামড়ানোর পর বাম হাতের কনিষ্ঠা (কনুই) আঙ্গুলে পচন ধরে। এরপরে ওষুধ খেতে খেতে কুকড়া অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। সাপে কামড়ানো আঙ্গুলে হাত দিলে ব্যথা করে। এই হাতের আঙ্গুলের সাহায্যে কোন কাজ করা যায় না। একটু আঘাত লাগলে রক্ত বের হয়ে যায়। এখনও আঙ্গুলের ভেতরে ক্ষত হয়ে আছে। সাপের (রাসেলস ভাইপার) কামড়ে চিকিৎসা বাবদ তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সেই ধাক্কায় প্রাণে বেঁচে গেছে।
আলম বিশ্বাসের স্ত্রী নাওজান বেগম বলেন, গত বছর পদ্মার চরে সাপে কামড় দেয়। বাড়িতে নিয়ে আসার পরে তার চোখ মুখ নীল হয়ে গিয়েছিল। তার মুখে কথা ছিল না। তাকে দেখে আমি হাওমাও করে কান্নাকাটি শুরু করি। এই কথা মনে হলে এখনও আমার শরীরের লোম জেগে উঠে। সেই সাপটা বড় ছিল। শুধু এক নজর দেখেছিলাম সাপটি। তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাঘার মনিকগ্রামে ওঝার কাছে। সেখানে ওঝা তাকে কিসের জানি পাতা খেতে দিয়েছিল। এক ঘণ্টা পরে তার জ্ঞান ফিরেছিল।
নাওজান বেগম আরও বলেন, ‘তার আগে বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়েছিল। পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে ১৫ দিন চিকিৎসা নেওয়া হয়। এরপরে নেওয়া হয় কুষ্টিয়া জেলায়। এখন সে তেমন কোন কাজ-কাম করতে পারে না। এই আঙ্গুল নিয়ে কিছু ধরলে এখনও রক্ত পড়ে। ফলে এক হাতে সব কাজ করতে হয়।’
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু শাহীন বলেন, দীর্ঘদিন ব্যথা হতে পারে। তবে সার্বিক বিষয় নিয়ে রোগীর সাথে যোগাযোগ করতে চান এই চিকিৎসক।
এ বিষয়ে রাসেলস ভাইপার উদ্ধার নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের প্রশিক্ষক বোরহান বিশ্বাস বলেন, দীর্ঘ সময় ব্যাথা থাকে। তার আঙ্গুলের সমস্যা হয়েছে। অনেকের চোখ ছাড়াও শরীরে বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি হয়। তবে এই প্রশিক্ষক ও রোগীর সাথে যোগাযোগ করতে চান।
এদিকে শাকিল হোসেন ১ জুলাই মানিকের চরে বাদাম উঠানোর কাজে গিয়ে রাসেলস ভাইপার তার হাতে ছোবল দেয়। সে ভীতু না হয়ে ওই রাসেলস ভাইপার ধরে বস্তায় বন্দি করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। ২১ জুন পলাশি ফতেপুরচরের জনি আহমেদ পদ্মা থেকে জাল তুলে বাড়ি ফেরার পথে একটি রাসেলস ভাইপারকে পিটিয়ে মারে। ২ জুলাই কালিদাসকালী চরের দুল জান বেওয়ার শয়ন ঘরে একটি রাসেলস ভাইপার সাপ দেখতে পেয়ে তার নাতী সেলিমকে সাথে নিয়ে মারা হয়।
দাদপুর চরের আবদুল মান্নান ৩ জুলাই বাড়ির পাশে একটি, ২৭ জুন চৌমিাদিয়া চরের কামাল হোসেনের বাড়ি পাশে, চরকালিদাসখালী চরের সহিদুল মোল্লার বাদাম খেতে এবং পশ্চিম কালিদাসখালী চরের মিজানুর রহমান বাড়ির পাশে একটি করে রাসেল ভাইপারটি মেরেছেন বলে জানা গেছে। এই রাসেলস ভাইপার নিয়ে পুরো চরে আতংক বিরাজ করছে।
এ বিষয়ে আলম বিশ্বাস বলেন, রাসেলস ভাইপারে কামড় দেওয়ার পর ডাক্তার ও বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা করিয়ে ৩ লাখ টাকা খরচ হয়। এরপর আমি নিঃস্ব হয়ে যায়। আমার নিঃস্বর অবস্থা দেখেও ছেলেরা ফেলে চলে গেছে। বর্তমানে মেয়েদের সহায়তায় সংসার চলচিল। আগের ঋণ পরিশোধ করে মেয়ের কাছে থেকে টাকা নিয়ে ১৭ বিঘা জমিতে বাদামের চাষ করেছিলাম।
কিন্তু রাসেলস ভাইপারের ভয়ে শ্রমিক না পাওয়ায় বাদাম উঠাতে পারি নাই। এরমধ্যে পদ্মায় নতুন পানি আসায় ১০ বিঘা জমির বাদাম তলিয়ে গেছে। ফলে তিন লক্ষ টাকা ঋণ পড়েছি।
চকরাজাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবলু দেওয়ান বলেন, পদ্মায় পানি বাড়ার সাথে সাথে পাড় ভেঙেছে। অনেক জায়গা প্লাবিত হয়েছে। ফলে সাপের আশ্রয়স্থানগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। তাই সাপ উচু স্থান বেছে নেয়ার চেষ্টা করছে। ফলে, নদীবর্তি এলাকাগুলোতে বেড়েছে সাপের উপদ্রব। তবে, সাপের উপদ্রব এড়াতে চরের লোকজনকে সাবধানে চলাচলের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
সোনালী বার্তা/এমএইচ