সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৮ অপরাহ্ন

এখন আমি কার কাছে নালিশ দেব, বাবা তো নাই

নিজস্ব প্রতিবেদক / ৬২ Time View
Update : শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০২৪

বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার প্রত্যন্ত এক গ্রাম পূর্ব সালিকাবাঁকপুর। বরিশাল-বানারীপাড়া সড়ক থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে চলে গেছে আরেকটি সরু পিচঢালা সড়ক। এই সড়ক ধরে কিছুদূর এগোতেই বাঁকপুর গ্রামের মাদ্রাসার পাশ দিয়ে আরেকটি সরু সড়ক গেছে সোজা পশ্চিম দিকে। কয়েক দিনের বৃষ্টিতে সড়কটি কাদাজলে একাকার। কাদাজল মাড়িয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নিহত জসিম উদ্দীনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, গাছগাছালিতে ভরা বাড়ির চারপাশ। বাড়িতে ঢুকতেই নিহত জসিমের কবর চোখে পড়ল। জসিমের ভাই সাহাবুদ্দিন ছলছল চোখে হাত উঁচু করে দেখাতে দেখাতে বলছিলেন, ‘ওইখানে আমার ভাই শুয়ে আছে।

সুমী আক্তার (২৮) এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চুপচাপ, নির্বাক। ঢাকায় গুলিতে মারা যাওয়া অটোমোবাইলস দোকানের ব্যবস্থাপক জসিম উদ্দীনের স্ত্রী তিনি। স্বামীর মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই মুখে দানাপানি নিচ্ছেন না সুমী। পরিবারের সবাই জোর করায় দুই দিন ধরে সামান্য খাবার মুখে তুলে দিতে পারলেও কারও সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না। মায়ের মতোই চুপসে গেছে তাঁর ১০ বছরের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস। বাবার আকস্মিক মৃত্যুর খবরে ছোট্ট মেয়েটিও শোকে মুষড়ে পড়েছে।

টিনের ছোট্ট ঘরজুড়ে নিস্তব্ধতা। সাহাবুদ্দিন তাঁর বড় ভাই নিজাম উদ্দীনকে ঘরের ভেতর থেকে ডেকে আনলেন বারান্দায়। এই প্রতিবেদকের পরিচয় জেনে নিজাম উদ্দীন কেঁদে ফেললেন। বললেন, আমার ভাই, কোনো দিন রাজনীতি করেনি। ঢাকায় ২০ হাজার টাকা বেতনে ছোট্ট একটা চাকরি করে বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানদের জন্য টাকা পাঠাত। এক নিমেষে সব শেষ হয়ে গেল। বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন নিজাম।

ফোঁপাতে ফোঁপাতে ছোট্ট জান্নাতুল বলছিল, ‘বাবা যে মারা গেছে, সেদিন দুপুর ১২টায় আমাকে ফোন দিয়ে বলেছিল, “স্কুল থেকে যাওয়ার সময় তোমার কাকার দোকান (এলাকার পরিচিত দোকানি) থেকে দাদির জন্য ফল নিয়ে যেয়ো। আমি পরে টাকা শোধ করে দেব।” এই ছিল বাবার সঙ্গে শেষ কথা।’ বলেই অঝরে কেঁদে ফেলে জান্নাতুল। বুক চাপড়াতে চাপড়াতে সে বলছিল, মা আমার লগে রাগারাগি করলে বাবারে ফোন দিতাম। বাবা বলত, তোমার আম্মুকে এবার বাড়িতে এসে অনেক বকে দেব। এখন আমি কার কাছে নালিশ দেব, বাবা!

নিজাম উদ্দীন বলেন, জসিম উত্তরায় একটি অটোমোবাইলসের দোকানে চাকরি করতেন। থাকতেন ওই দোকানের গ্যারেজেই। গত বৃহস্পতিবার মালিকের নির্দেশে তিনি ও অপর এক সহকর্মী উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে যান গাড়ির কিছু যন্ত্রাংশ কিনতে। কিনে আসার পথে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। ঘটনাস্থলেই মারা যান জসিম। তাঁর বুকে একটি বুলেট বিদ্ধ হয়েছিল। মুখমণ্ডল ও সারা শরীরে ছিল অসংখ্য রাবার বুলেটের ক্ষত। খবর পেয়ে তিনি (নিজাম) চট্টগ্রামের কর্মস্থল থেকে ছুটে যান ঢাকায়। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে লাশ গ্রহণ করে আজ শুক্রবার ভোরে নিয়ে আসেন বাড়িতে। সেখানেই জানাজার পর দাফন হয়।

নিজাম আরও বলেন, আমার ভাই মরে গেছে, এখন আর কার কাছে বিচার চাইব। কেই-বা বিচার করবে? আমরা যে গরিব, জীবনটা কীভাবে টিকিয়ে রাখব, সেই চিন্তায় দিন যায়, তার পর তো বিচার।

দুপুর গড়িয়ে গেছে। ফেরার সময় নিহত জসিমের স্ত্রী সুমী আক্তারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বারান্দায় আসেন। তাঁর কাঁধে ছোট্ট সাইফ তখনো গভীর ঘুমে নিমগ্ন। তাঁর বিধ্বস্ত চেহারা দেখে বোঝা গেল, কতটা ঝড় বইছে জীবনের ওপর দিয়ে। মাথা নিচু করে নীরবতা ভেঙে তিনি শুধু বলছিলেন, ‘ছোট্ট এই বাচ্চাদের নিয়ে আমি এখন কোথায় যাব, কী করব, কিছুই জানি না।’ তাঁর নিষ্প্রভ দৃষ্টি, কান্নার মতো জল যেন আর তাঁর চোখে অবশিষ্ট নেই।

সোনালী বার্তা/এমএইচ


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
এক ক্লিকে বিভাগের খবর