সাগর-রুনির তদন্ত এবার শেষ হবে কি
শিশু মাহিন সরওয়ার মেঘ ৫ বছর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়েছে। বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে সে এখন টগবগে কিশোর। মেঘের কৈশোর কেটেছে ক্রিকেটের সঙ্গে। এখনও ২২ গজই তার ধ্যান জ্ঞান, জার্সিও বানায় নিজে। ব্যাটহাতে সেঞ্চুরি কার না ভালো লাগে! কিন্তু মেঘের জীবনে অন্যরকম এক ‘সেঞ্চুরি’র গল্প কষ্টের, হতাশার। বাবা-মায়ের মৃত্যুর তদন্ত চলছে ১২ বছর ধরে, আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে ১১১ বারের মতো ব্যর্থ হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।
মেঘের বাবা-মা আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরোয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর রাজাবাজারে ভাড়া বাসায় তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সবশেষ গত জুন মাসেও এই হত্যাকাণ্ডে দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময়সীমা ৪ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। এ নিয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে এ পর্যন্ত ১১১ বার সময় বাড়ানো হয়েছে।
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মো. শফিকুল আলম সেদিনও প্রতিবেদন দাখিল করতে ব্যর্থ হন। খন্দকার মো. শফিকুল আলম মামলার সপ্তম তদন্ত কর্মকর্তা। ২০১৯ সালের ৭ জুলাই তাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১২ বছর ধরে তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দিতে পারায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো হতাশা প্রকাশ করে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতীয় সংসদকে জানিয়েছিলেন, সাংবাদিক দম্পতি হত্যার তদন্ত শেষ করার কোনও সময়সীমা বেঁধে দেওয়া সম্ভব নয়। এর আগে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাগর-রুনির খুনিদের খুঁজে বের করতে যদি তদন্ত ৫০ বছর লেগে যায়, তাহলে দিতে হবে।’
২০১২ সালে এই সাংবাদিক দম্পতি নিজ ভাড়া বাসায় খুন হওয়ার পরদিন সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ঘটনাস্থলে এসে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতারের কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেই ৪৮ ঘণ্টার ফলাফল ১২ বছরে এসেও শেষ হয়নি। ২০১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মামলা দায়েরের পর শেরেবাংলা নগর থানাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিন দিন পর মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাদের ব্যর্থতার পর মামলাটি র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয় ওই বছরের ১৮ এপ্রিল।
২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মামলাটি তদন্তের জন্য প্রথমে ডিবি উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলমকে তদন্তভার দেওয়া হয়। এরপরে পর্যায়ক্রমে র্যাবের সহকারী পরিচালক মো. ওয়ারেছ আলী মিয়া, আরেক সহকারী পরিচালক সহিদা রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মো. শফিকুল আলম, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার জাফর উল্লাহ ও সহকারী পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন আহম্মেদ মামলাটি তদন্ত করেন। ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, ওই বছরের ৭ জুন, ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর ও সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২১ মার্চ তদন্তে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। প্রতিবেদনগুলো প্রমাণ করে আসলে তদন্তের কোনও অগ্রগতি ঘটেনি।
মামলার ৮ আসামির দুই জন বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল ও তার কথিত বন্ধু তানভীর রহমান জামিনে আছেন। অপর ছয় আসামি মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু, বকুল মিয়া, কামরুল হাসান অরুন, রফিকুল ইসলাম, এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির ও আবু সাঈদ কারাগারে রয়েছেন। এ মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার ৮ জনের কেউই এখনও পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেনি।
২০২০ সালের ৭ অক্টোবর আরেকটি অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। অগ্রগতি প্রতিবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন,ঘটনাস্থল থেকে জব্দ করা আলামত ডিএনএ পরীক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফরেনসিক সার্ভিসে (আইএফএস) পাঠানো হয়েছিল। আইএফএস দুই অজ্ঞাত পুরুষের ডিএনএ শনাক্ত করেছে। পরে সেটি শনাক্তকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
হত্যার ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলী রোমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা থানায় মামলা করেন। সরকার পরিবর্তন হওয়ায় নতুন করে বিচার প্রক্রিয়া গতি পাবে এবং প্রকৃত খুনিদের দেখা যাবে, আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আমরা এবার প্রচণ্ড আশাবাদী। সবসময় ভাবতাম, যে সরকারের আমলে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, বিচারের নামে যে প্রহসন হয়েছে, সে সরকার চলে গেলে যে সরকারই আসুক, বিচারের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু লম্বা সময় হয়ে যাওয়ার কারণে কিছুটা সংশয় ছিল যে, এতদিন সরকার ক্ষমতায় থাকার পরে আলামত ঠিক থাকবে কিনা। কিন্তু ‘আয়নাঘর’ দেখা এবং সেখান থেকে এতবছর পরে মানুষ ফিরে আসা দেখে বিচার হওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় মনে হচ্ছে এবার হয়তো আমরা বিচার পাবো এবং আমরা খুবই আশাবাদী। হয়তো সময় লাগবে, জানি না কী হবে। কিন্তু আমরা আশাবাদী যে, বিচার প্রক্রিয়াটা সুন্দরভাবে শুরু হবে এবং আমরা সুষ্ঠু তদন্তের মধ্য দিয়ে প্রকৃত যারা অপরাধী, তাদের দেখতে পাবো এবং বিচারটা পাবো।
সোনালী বার্তা/এমএইচ