অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাসে কী অর্জন, সামনে কী চ্যালেঞ্জ
জুলাই অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক মাস পূর্ণ হলো আজ রোববার (৮ সেপ্টেম্বর)। দিনের হিসাবে মাত্র ৩০ দিন।
অহিংস কোটা সংস্কার আন্দোলনকে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের দিকে নিয়ে যায় বিগত সরকার। গোটা দেশে ছাত্র-জনতার রক্ত ঝরিয়ে গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা।
মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে তিন দিন পর ৮ আগস্ট শপথ নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ছাত্র-জনতার মূল দাবি, রাষ্ট্র সংস্কারই হয়ে ওঠে সরকারের লক্ষ্য।
দায়িত্ব গ্রহণের আগের তিন দিন দেশে কোনো সরকার ছিল না। অচল হয়ে পড়ে মনোবল ভেঙে যাওয়া পুলিশ বাহিনী। ফলে বেড়ে যায় ছিনতাই-ডাকাতি। ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দেয় সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা। নতুন সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল এই নৈরাজ্য ঠেকানো। সরকারের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকের পর ১১ আগস্ট থানায় ফেরা শুরু করেন পুলিশ সদস্যরা। বিগত সরকারের আইজিপি থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের অবসরে পাঠিয়ে নতুন নিয়োগ দেয়া হয়।
প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়েও শুরু হয় ব্যাপক রদবদল। স্বৈরাচারী সরকারের নিয়োগকৃত চুক্তিভিত্তিক সব সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় ড. ইউনূসের সরকার। সংস্কারের উদ্যোগ হিসেবে বেশিরভাগ মন্ত্রণালয়, দফতর ও অধিদফতরের দায়িত্বে আসে নতুন মুখ।
১০ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের নিয়োগকৃত প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগেও বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। আগের নিয়োগ বাতিল করে সারা দেশে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পদে ২২৭ জন আইনজীবীকে নতুন নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে গত এক মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ শীর্ষ পদের ব্যক্তিরা দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে। খালি রয়েছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ।
কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও পাল্টেছে অবস্থান। এখন যেন একটু ফ্রন্ট ফুটে বাংলাদেশ। বিএসএফের গুলিতে মৌলভীবাজারে স্বর্ণা দাস নামে এক কিশোরী হত্যায় দিল্লিকে কড়া প্রতিবাদ জানায় ঢাকা। ফেনীর আকস্মিক বন্যার কারণও জানতে চাওয়া হয় ভারতের রাষ্ট্রদূতের কাছে। এছাড়া জাতিসংঘের গুমবিরোধী যে সনদে শেখ হাসিনা সরকার দীর্ঘদিন স্বাক্ষর করেনি তাতে সই করে অন্তর্বর্তী সরকার। আর জুলাই আন্দোলনের সময় বিক্ষোভ করে আরব আমিরাতে সাজাপ্রাপ্ত ৫৭ বাংলাদেশিকে মুক্তির বিষয়ে দেশটির প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলে ক্ষমার ব্যবস্থা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা নতুন সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনবিআর চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে বেশিরভাগ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের সরিয়ে নতুন নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ভোক্তাদের কষ্ট কমাতে নিত্যপণ্যের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে সরকার।
অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণের ব্যাপারে অ্যাকশন নেয়া হচ্ছে। যেসব ব্যাংকে সমস্যা আছে, সেগুলো পুনর্গঠন করা হচ্ছে। তারল্য সংকট সমাধান করা হচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যেই বলে দিয়েছি, অর্থ আনার জন্য একটা টাস্কফোর্স হবে। তারপরে সংস্কারের ব্যাপারে কথা বলছি।
সারা দেশের স্থানীয় জনপ্রতিধিদের সরিয়ে বসানো হয়েছে নতুন প্রশাসক। সরকারের উপদেষ্টারা বলছেন, দীর্ঘদিনের অচলায়তন কাটাতে কিছুটা সময় লাগবে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, জনগণ আমাদেরকে দিয়ে কোন কোন সংস্কার করাতে চায়, সেই জায়গা থেকেই সময়টা নির্ধারণ হবে। এর জন্য যতটুকু সময় প্রয়োজন, ততটুকু সময় আমরা নেব।
আন্দোলনের ফলস্বরূপ গঠিত নতুন সরকার নিজেরা গত মাসে অনেকগুলো আন্দোলনের মুখোমুখি হয়েছে। সংখ্যালঘু নিরাপত্তা আন্দোলন, এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল, পোশাক শ্রমিক আন্দোলন, রিকশাওয়ালা ও ডাক্তাররা নানা দাবিতে নেমেছিল আন্দোলনে। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় সেগুলো সুরাহা হয়। তবে বেগতিক দিকে মোড় নেয় আনসার আন্দোলন। শিক্ষার্থীরা মুখোমুখি হয়ে সে আন্দোলন প্রতিহত করে। তবে আন্দোলনের মাঠ থেকে উপদেষ্টা হওয়া আসিফ মাহমুদ বলছেন, আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করাই সরকারের প্রধান লক্ষ্য।
তিনি বলেন, ১৬ বছর ধরে দেশের মানুষ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে ছিল। কেউ কোনো কথা বলতে পারেনি। এখন একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে; জনগণের সরকার গঠন হয়েছে। তাই মানুষ তাদের আকাঙ্ক্ষা এবং বঞ্চনার জায়গা থেকে কথা বলছেন। সেটাকে আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। সরকারের সব সময় প্রথম অগ্রাধিকার হবে আলোচনা করা। সংবিধান থেকে শুরু করে প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের কাজ করা হবে।
সামনের দিনে সংবিধান সংস্কারসহ বেশ কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে এই সরকারের কাছে। অচিরেই রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা দেয়া হবে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে।
সোনালী বার্তা/এমএইচ