৬০০ কোটি টাকার দুর্নীতি ধামাচাপা দিয়েছে দুদক
গ্রানাইট খনিতে পাথর উত্তোলনের নামে ৬০০ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ধামাচাপা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির প্রকাশ্য অনুসন্ধানে ভয়াবহ এই দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পেয়ে চারটি মামলার সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। মামলায় পেট্রোবাংলা, বাপেক্স ও গ্রানাইট খনির ১৩ শীর্ষ কর্মকর্তাকে আসামি করার সুপারিশ করা হয়েছিল। কমিশন সেই প্রতিবেদন আমলে না নিয়ে ‘কোয়ারি’ দিয়ে ফেরত পাঠায়। অনুসন্ধান কর্মকর্তা কোয়ারির জবাবেও মামলার সুপারিশে অটল থাকেন। এরপর তাকে সরিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয় নতুন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। ২ বছরের বেশি সময় ধরে অনুসন্ধান করে প্রথম কর্মকর্তার প্রতিবেদন পালটে ফেলেন দ্বিতীয় অনুসন্ধান কর্মকর্তা। অভিযোগ পরিসমাপ্তির সুপারিশ করে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করেন তিনি। দুদক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-মামলার সুপারিশ করা প্রতিবেদন পালটে অভিযোগ পরিসমাপ্তির প্রতিবেদন তৈরিতে লেনদেন হয়েছে ১০ কোটি টাকা! দুদকের ঊর্ধ্বতনদের যোগসাজশে মোটা অঙ্কের এই ঘুসের বিনিময়ে অভিযুক্তদের ছাড় দেওয়া হয়েছে। তবে দায় এড়াতে এ ঘটনা তদন্তের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়কে তদন্তের দায়িত্ব দিয়ে চিঠি পাঠায় দুদক। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এ ঘটনায় স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় দুদকের ভেতরেই ‘দুর্নীতির ভূত’ আছে। সংস্কারের মাধ্যমে এই ভূত দূর করতে না পারলে দুদকের কাজে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব নয়। আর দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, অভিযোগটি নতুন করে অনুসন্ধান করলে এই দুর্নীতির ঘটনায় খোদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেক রাঘববোয়াল ফেঁসে যাবেন-এমন তথ্য আছে। এ কারণে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ইতোমধ্যেই ভেতরে ভেতরে নতুন করে অনুসন্ধান চালুর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের বিশ্বাসযোগ্য সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ থাকার পরই যাচাই-বাছাই কমিটির সুপারিশে দুদক অনুসন্ধান করে। যেখানে ২ বছরের অনুসন্ধানের পর অনুসন্ধান কর্মকর্তা মামলার সুপারিশ করেছেন, সেখানে আরেক কর্মকর্তার পরিসমাপ্তির জন্য প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। তাছাড়া যেখানে মন্ত্রণালয়ের অধীনে চাকরি করা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, সেখানে এই অভিযোগের অনুসন্ধান চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানোর যৌক্তিকতা নেই। প্রভাবশালীদের ছাড় দেওয়ার জন্য এটা করা হয়েছে-এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
আরও জানা গেছে, সরকারি চুক্তির মাধ্যমে ২০১৪ সাল থেকে খনিটি পরিচালনা ও পাথর উত্তোলনের দায়িত্ব পায় জিটিসি। কোম্পানিটির সঙ্গে সম্পাদিত ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার চুক্তি অনুযায়ী খনিতে ৬ বছরে ১২টি স্টোপ নির্মাণ করে সেখান থেকে ৯২ লাখ টন পাথর উত্তোলনের বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু মাত্র ৩০ লাখ টন পাথর উত্তোলন করে চুক্তি মূল্যের ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার পুরোটাই সরকারের প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে হাতিয়ে নেয় জিটিসি। এই চুক্তিপত্র প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। এ কারণে এই দুর্নীতির দায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এড়াতে পারেন না বলে মনে করেন দুদকের একাধিক কর্মকর্তা। তাই নতুন করে অভিযোগের অনুসন্ধান করলে এই মামলায় শেখ হাসিনাসহ অনেকেই ফেঁসে যাবেন।
অনুসন্ধান প্রতিবেদনের তথ্য : অনুসন্ধান প্রতিবেদনে যাদের আসামি করার সুপারিশ করা হয় তারা হলেন-রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার সিরাজুল ইসলাম কাজী, পেট্রোবাংলার তৎকালীন পরিচালক (পিএসসি) মোহাম্মদ আবুল বাসার, অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. আমিনুজ্জামান, অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক মো. মাহমুদ খান, বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মো. আব্দুল হান্নান, মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক মো. আসাদুজ্জামান, উপমহাব্যবস্থাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন, উপমহাব্যবস্থাপক আতিয়ার রহমান, উপমহাব্যবস্থাপক সৈয়দ রফিকুল ইসলাম, উপমহাব্যবস্থাপক মো. উবায়দুল্লাহ, উপমহাব্যবস্থাপক মো. আব্দুল মাজেদ, মধ্যপাড়া গ্রানাইট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবিএম কামরুজ্জামান ও ব্যবস্থাপক সুদীপ্ত পাল।
জানা গেছে, নতুন করে অনুসন্ধানের দায়িত্ব পাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে এই দুর্নীতির অভিযোগ পরিসমাপ্তি করেন আলোচিত দুদক কর্মকর্তা সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তার হাত ধরে শুধু এ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়নি। এ ধরনের এন্তার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিনি যে কোনো অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পাওয়ার পরই দুদকে হাজির হতে গণহারে নোটিশ করেন। এরপর শুরু করেন ‘ধরাছাড়া’ বাণিজ্য। দুদকের নিয়ন্ত্রক হিসাবে পরিচিত ‘ভাড়াটে’ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে তিনি এসব কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে বস্তাভর্তি ৩ কোটি টাকা ও বিদেশি মুদ্রা উদ্ধারের ঘটনায় আলোচিত সিনিয়র সচিব শাহ কামালের দুর্নীতি অনুসন্ধান পরিসমাপ্তি করেছিলেন এই কর্মকর্তা। আবার তার বাসায় টাকা উদ্ধার অভিযানেও যান তিনি। অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাদের দুর্নীতির অভিযোগের অনেক ফাইল নিয়ে এখনো ‘খেলাধুলা’ করছেন। পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের অভিযোগের অনুসন্ধান টিমের দলনেতা হিসাবে নাফিসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে এক সময় দুদক চেয়ারম্যানকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন এই কর্মকর্তা। ঢাকা ওয়াসার বিতর্কিত ও আলোচিত সাবেক এমডি তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অনুসন্ধান কর্মকর্তাও নজরুল। এই সুযোগে তিনি ওয়াসার ২০-২৫ জন প্রকৌশলী ও বহু কর্মকর্তাকে ডেকে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দিয়ে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ ওয়াসা ভবনে ওপেন সিক্রেট। আরও জানা গেছে, আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন হতে সাবেক এমপি অসীম কুমার উকিল ও তার স্ত্রী অপু উকিলের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পরিসমাপ্তি করার সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেন তিনি। আবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী আনিস আহমেদ গোর্কির বিরুদ্ধে মামলা করেন, যার কোনো ভিত্তি নেই। সাউথইস্ট ব্যাংকের এমডি এম কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে শতকোটি টাকার দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরও অনুসন্ধান শেষে অভিযোগ পরিসমাপ্তি করেন। সবশেষ বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের ঘটনা অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসাবে তিনি ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তথ্য-উপাত্ত জমা দেওয়ার অনুরোধ করে ৩৮ জনকে নোটিশ করেন। ৫ সেপ্টেম্বর এ ঘটনাকে অগ্রহণযোগ্য বলে বিবৃতি দেয় বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। খোদ দুদক কর্মকর্তাদের অনেকেই বলেছেন, নজরুল ইসলামের কর্মকাণ্ড দুদকের কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য নয়। এতে দুদকের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন করছে।
জানতে চাইলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, রুটিন মামলা হিসাবে অনুসন্ধান করে গ্রানাইট খনি দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধানে সত্যতা না পাওয়ায় পরিসমাপ্তির সুপারিশ করে প্রতিবেদন দেই। ১০ কোটি টাকা ঘুস লেনদেনের অভিযোগ সত্য নয়। পদ্মা ব্যাংকের দুর্নীতির অনুসন্ধান আমার কাছে আছে, কিন্তু নাফিজ সরাফাতের সঙ্গে আমার কোনো ঘনিষ্ঠতা নেই। অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ফাইল না দেখে সব বিষয়ে মন্তব্য করা সম্ভব নয়।
সোনালী বার্তা/এমএইচ