রাজশাহীতে গুম হওয়া তিনজনের সন্ধান মিলেনি ৭ বছরেও
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার মাড়িয়া ইউনিয়নের কাঁঠালবাড়ি গ্রামের স্কুল শিক্ষক মরহুম আব্দুস সামাদের বিধবা স্ত্রী আবেদা বিবি প্রতিদিন বাড়ির দরজার সামনে বসে থেকে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে যতদুর দৃষ্টি যায়। এই বুঝি আসছে ছেলেটা। সাত বছর ধরে সন্তান হারা এই মায়ের যেন অপেক্ষার শেষ হয় না। সাত বছর আগে হাটে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি আবেদা বিবির একমাত্র ছেলে আব্দুল কুদ্দুস।
২০১৭ সালে ২০ দিনের ব্যবধানে রাজশাহীর বাগমারা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া আব্দুল কুদ্দুসসহ তিন ব্যক্তির সন্ধান ৭ বছরেও পাওয়া যায়নি। সে সময় থানায় সাধারণ ডায়েরি হলেও নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধারে কোনো তৎপরতা ছিল না পুলিশের। র্যাব কার্যালয়ে বারবার ধর্ণা দিয়েও কোন সাড়া পায়নি তাদের পরিবারের সদস্যরা। এ ঘটনায় গত ৯ সেপ্টেম্বর নতুন করে থানায় অভিযোগ দেওয়া হলেও সেটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়নি।
রাজশাহী জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, গুমের ঘটনা তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। বিষয়টি এখন কমিশনই তদন্ত করবে। তদন্ত প্রতিবেদনে যে নির্দেশনা আসবে সে অনুসারে কাজ করবে পুলিশ। এ কারণে তাদের অভিযোগ মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়নি। কমিশনের কাছে তাদের কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয়েছিল। বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বাগমারা থেকে গুম হওয়া তিনজনের কাগজপত্র গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশনে জমা দিয়েছে তাদের পরিবারের সদস্যরা।
গুম হওয়া আব্দুল কুদ্দুসের মা আবেদা বিবি বলেন, আমার চার মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলেটা পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ ও বাড়িতে গরুর খামার করেছিল। একদিন গরুর বাছুর কিনবো বলে দেড় লাখ টাকা নিয়ে হাটে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে যার। আমার ছেলেটা আর আসল না। ছেলের শোকে আমার স্বামী অসুস্থ্য হয়ে ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর মারা যান।
২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল বিকেলে গরু কেনার জন্য নওগাঁর আত্রাই উপজেলার আহসানগঞ্জ হাটে যাচ্ছিল আব্দুল কুদ্দুস। সাথে ছিলেন তারা চাচা আসকান আলী, প্রতিবেশী আমিনুল ইসলাম ও রুহুল আমিন। তারা সাবাই একটি রিকশা ভ্যানে যাচ্ছিল।
আসকান আলী বলেন, পথে বারইহাটি মোড়ে পৌঁছালে দুই মোটরসাইকেল আরোহী আমাদের ভ্যানের সামনে দাড়িয়ে যায়। তারা নিজের প্রশাসনের লোক পরিচয় দিয়। এ সময় কুদ্দুস ভ্যান থেকে নেমে দৌড় দেয়। দৌড়ে গিয়ে একটি পুকুরে ঝাপ দেয়। সেখানে তারা গিয়ে কুদ্দুসকে ধরে হান্ডকাপ ও মাথায় হেলমেট পড়িয়ে নিয়ে যায়। কুদ্দুসের কাছে থাকা দেড় লাখ টাকাও তারা নিয়ে নেয়। এ সব তারা পিস্তল ধরে বলে কেউ কাছে আসবেন না। আমরা প্রশাসনের লোক। এর পর থেকে তার আর সন্ধান মেলেনি।
তবে প্রায় দেড় বছর পর সেজো বোনের স্বামীর মমতাজ উদ্দিনের মুঠোফোনে কল করে কথা বলেন আব্দুল কুদ্দুস। জানায় তার অবস্থার কথা। এর পর আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি পরিবারের সদস্যরা।
মমতাজ উদ্দিন বলেন, ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে হটাৎ করেই আব্দুল কুদ্দুস আমার নাম্বারের ফোন দেয়। সে জানান, ‘সেখানে ডিউটিরত এক পুলিশকে ম্যানেজ করে তার ফোন থেকে কল করেছে। র্যাব তাকে একটি অন্ধকার ঘরে আটকে রেখেছে। সামান্য খামার দেয়। আবার মাঝে মাঝে টর্চার সেলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে। আমি ভালো নেই। এখন থেকে বের হতে পারবো কিনা জানিনা।’ এর পর ওই নাম্বারটি আর চালু পাওয়া যায়নি।
কুদ্দুসের ছোট বোন পারভীন নেছা বলেন, ফোনে কথা বলার পর আমরা র্যাব আফিসে একাধিকবার গিয়েছি। পুলিশের কাছে গিয়েছি। তারা দেখছি বলে। কিন্তু কোন পদক্ষেপ নেয়নি। র্যাব ও পুলিশ আমাদের সঙ্গে ঠিকমত কথাও বলে না।
তিনি বলেন, হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে পাঁচ সদস্যের গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন। বৃহস্পতিবার তার ভাই আব্দুল কুদ্দুসসহ বাগমারা থেকে গুম হওয়া তিনজনের কাগজপত্র জমা দিয়েছি।
আবদুল কুদ্দুসকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ছয়দিন আগে ৩০ মার্চ হামিরকুৎসা গ্রামের আরেক আব্দুল কুদ্দুস এবং ১৩ দিন পর ১৯ এপ্রিল উপজেলার গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের তালতলি এলাকা থেকে একই কায়দায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয় পলাশী গ্রামের মুরশিদুল আলমকে। তাদের তিনজনের পরিবারই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
সোনালী বার্তা/এমএইচ