সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ০৯:৩৬ অপরাহ্ন

বিলের শাপলা বিক্রি করেই চলে ৪’শ পরিবারের জীবিকা

কাজী মকবুল, গাজীপুর প্রতিনিধি / ১৫৭ Time View
Update : রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

সারাদিন কাঠফাটা রোদ কিংবা মুষলধারে বৃষ্টি যাই হোক না কেন বিলে ওদের যেতেই হবে। শাপলা তুলতেই হবে। না হলে সংসার চলবে কি করে? এ মৌসুমে বিলের শাপলাই তাদের অন্ন জোগাতে ভূমিকা রাখছে। জাতীয় ফুল শাপলা বিক্রি করেই গাজীপুরের তিন উপজেলার বিল পাড়ের মানুষদের বেশির ভাগ সময় ব্যয় করতে হয়। কারণ এই শাপলাই তাদের প্রতিদিনের অন্ন জোগাতে ভূমিকা রাখছে। বর্ষা শুরুর পর শ্রাবণ থেকে অগ্রহায়ন মাস পর্যন্ত ওইসব গ্রামের কমপক্ষে ৪০০ পরিবার শাপলা বিক্রি করে। বিল থেকে সংগ্রহ করেন পরিবারের পুরুষেরা আর প্রক্রিয়াজাতের সিংহভাগ কাজ করেন নারীরা।

গাজীপুরের কালীগঞ্জ, শ্রীপুর উপজেলার নলগাঁও, প্রহলাদপুর, ডুমনী, লক্ষীপুর, কাপাসিয়া উপজেলার টোকনয়ন বাজার, দুবার্টি, মোহানীসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ শাপলা বিক্রি করে বছরের কিছু সময় জীবিকা নির্বাহ করেন। বিলের কালচে পানির ওপর সবুজের ফাঁকে ফুটে আছে লাল শাপলা। সাদা শাপলা স্থানীয় বাজারগুলোতে সবজি হিসেবে বিক্রি হয়। লাল শাপলা বিশেষ উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করে ঢাকার বিভিন্ন ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হয়।

বর্ষা মৌসুমে উপজেলার কৃষক ও দিনমজুররা বিল থেকে শাপলা তুলে বিক্রি করে। শাপলা বিক্রি করে একজন ব্যক্তি দিনে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় করেন। কোনো পুঁজির প্রয়োজন না হওয়ায় বর্ষাকালে বিভিন্ন বয়সের মানুষ এ কাজে যুক্ত হন। শাপলা ফুল সাধারণত জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে শুরু করে কার্তিক মাস পর্যন্ত পাওয়া যায়। তবে মৌসুমের শেষ অর্থাৎ কার্তিক মাসে তেমন বেশি পাওয়া যায় না।

শ্রীপুর লগোয়া গাজীপুর সদরের লক্ষীপুর গ্রামের গৃহিণী অঞ্জনা দাস জানান, পুঁজি বলতে ৪ হাজার টাকায় একটি নৌকা কিনেছেন। শাপলা তুলে বিক্রি করে প্রতি মৌসুমে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। দুটি ছেলের পড়াশোনার খরচসহ সংসারের অন্য খরচও মেটাতে পারেন শাপলা বিক্রির টাকায়।

একই গ্রামের গৃহিণী দিপালী রানী জানান, নৌকা দিয়ে নদী থেকে শাপলা তুলে এনে কেটে রোদে শুকিয়ে বিক্রি করেন। ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে পারেন। বৃষ্টিতে ভিজে গেলে বা পচে গেলে দাম কম পান। গত বছর সর্বোচ্চ ১২০ টাকা কেজি দরে ১৬০ কেজি বিক্রি করেছেন।

গৃহিণী রীনা রানী জানান, তার ছেলে-স্বামী ভোর থেকেই বিলে শাপলা উঠানোর কাজ শুরু করেন। একটা নৌকা পর্যায়ক্রমে একাধিক পরিবার ব্যবহার করেন। শুকনো শাপলা সর্বোচ্চ ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন। গত ১০ বছর যাবত তারা শাপালা বিক্রি করে আসছেন। একজন নারী প্রতি মৌসুমে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। বিলের জায়গা মালিকানা থাকলেও কেউ শাপলা উঠাতে বাধা দেন না।

শ্রীপুরের নলগাঁও গ্রামের গৃহিণী শেফালী রানী বলেন, কমপক্ষে চার মাস পর্যন্ত শাপলা সংগ্রহ করতে পারেন। আবহাওয়া ভালো থাকলে শাপলা কেটে রোদে শোকাতে বিক্রিযোগ্য করতে কমপক্ষে পাঁচদিন সময় লাগে। বিলে পানি থাকে যতদিন, শাপলা পাওয়া যায় ততদিন।

একই উপজেলার প্রহলাদপুরের কৃষক লিটন দাস বলেন, গত ১০ বছর যাবত এসব এলাকায় লাল শাপলা সংগ্রহ ও বিক্রি করা হচ্ছে। সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত একজন ব্যক্তি একসাথে অনেক শাপলা সংগ্রহ করতে পারেন, যেগুলো শোকানোর পর কমপক্ষে পাঁচ কেজি হয়। পুরুষেরা শাপলা সংগ্রহ করেন। শোকানোর প্রক্রিয়া করেন নারীরা। বর্তমানে শাপলা ফুলের বাজার মুল্য বেশি হওয়ায় অনেকেই সকলেই শাপলা সংগ্রহের কাজ করেন। কমপক্ষে ১’শ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা যায়।

গাজীপুর সদর উপজেলার লক্ষীপুর গ্রামের বাসিন্দা ফাউগান উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লোকনাথ মন্ডল ও তার ভাই রৌদ্র মন্ডল জানায়, ছৈত্যের ডোপ বিলে লাল-সাদা-নীল শাপলা হয়। সাদা শাপলা খাওয়ার জন্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হয়। মনসা পূজায়ও সাদা শাপলা ব্যবহার করা হয়।

গাজীপুর মহানগরীর চতর বাজারের সবজি বিক্রেতা আব্দুল জব্বার জানান, এক কেজির আঁটি সাদা শাপলা প্রতি মুড়ি (আঁটি) ৭ টাকায় কিনে ১০ টাকায় বিক্রি করেন। একদিন পর পর স্থানীয়রা শাপলা তুলে বাজারে নিয়ে আসেন। শুকনা শাপলা পাইকাররা ওষুধ বানানোর জন্য বাড়ি থেকে কিনে নিয়ে যান। ১ মণ ৮ হাজার টাকায় বিক্রি করি। বারো পাইয়া বিল, পারুলী নদীর চারপাশ থেকে স্থানীয়রা শাপলা তোলেন।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চলগুলো বৃষ্টির পানিতে এখন টৈটুম্বুর। বিশেষ করে উপজেলার বিলগুলোতে এখন ভরা যৌবন। এ উপজেলায় ছোট-বড় ৪-৫টি বিল রয়েছে। এসব বিলে শোভা পাচ্ছে সাদা ও লাল রংয়ের শাপলা। জাতীয় ফুল শাপলা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন উপজেলার দুই ইউনিয়নের ৫ গ্রামের ৩ শতাধিক পরিবার।

কাপাসিয়ার পাঁচুয়া বাজার ব্যবসায় কমিটির সভাপতি আফতাব উদ্দিন জানান, সাধারণত বর্ষায় খাল-বিল, ডোবায় যখন পানি টইটম্বুর থাকে, তখন জলে ভাসতে দেখা যায় শাপলা। শুধু সৌন্দর্যই নয়, সুস্বাদু খাবার হিসেবেও শাপলার বেশ কদর রয়েছে। কাপাসিয়া উপজেলার নাইঘর, নাগাইশ, শিদলাই ও দুলালপুর পশ্চিম বিলে অপরূপ শোভা ছাড়াচ্ছে অগনিত শাপলা ফুল। দূর দূরান্ত থেকে প্রকৃতিপ্রেমীদের অনেকেই বিস্তীর্ণ জলাভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসছেন প্রায় প্রতিদিনই। অনেকে শাপলা তুলে নিয়ে যাচ্ছে এতে সুন্দর্য নষ্ট হচ্ছে।

লাল শাপলা বিল দেখতে আসা শিক্ষার্থী তম্ময় হাসান বলেন, ফেসবুকে এবং ইউটিউবে লাল শাপলার অনেক ছবি ও ভিডিও দেখেছি। তাই দেখতে চলে আসলাম। খুবই ভালো লেগেছে। এতো শাপলা আগে কখনও এক সাথে দেখিনি। অনেক ছবি তুলেছি। তা দেখে নিশ্চয় আমার বন্ধরাও আসতে চাইবে।

পাঁচুয়া বাজার সংলগ্ন বিলে কথা হয় মাঝি কাজল মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, আগে এখানে কোন নৌকা ছিল না। দর্শনার্থীরা ঘুরে দেখার জন্য আমি নৌকার ব্যবস্থা করি। প্রতিদিন অনেক মানুষ আসে। ঢাকা, নরসিংদী, গাজীপুর থেকে দল বেঁধে লোকজন আসে। তাদের বিল ঘুরিয়ে প্রতিদিন আমার প্রায় ৬-৭শ টাকা আয় হয়।

বিলের পাশের বাসিন্দা কলেজ শিক্ষার্থী নাজমুল আলম জানান, ভোরে বিলের জলে ফুটন্ত শাপলার আসল সৌন্দর্যের দেখা যায়। সূর্য ওঠার পর থেকে ফুটন্ত শাপলাগুলো আস্তে আস্তে মুখ গুটিয়ে নেয়। তাই এই সময়টিতেই শাপলার শোভা দেখতে আসা মানুষের ভিড় থাকে বেশি। বাড়ির পাশে এমন নয়ন জুড়ানো মুগ্ধতা দেখে খুব ভাল লাগে।

শাপলার রয়েছে একাধিক ভেষজ গুণ। এটি দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি তরকারি হিসেবে খেতেও সুস্বাদু। শাপলা কেউ খায় শখ করে, আবার কেউ খায় অভাবে পড়ে। শাপলা সাধারণত লাল ও সাদা রঙ্গের হয়। শাপলা খুব পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি। সাধারণত শাকসবজির চেয়ে এর পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। শাপলায় রয়েছে প্রচুর ক্যালসিয়াম। শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমাণ আলুর চেয়ে সাত গুণ বেশি। সাদা শাপলা চর্ম ও রক্ত আমাশয়ের জন্যও বেশ উপকারী। লাল শাপলা অ্যালার্জি ও রক্ত আমাশয়ের জন্য বেশ উপকারী। শাপলা প্রধানত অ্যাসিডিটি, অ্যানেসথেসিক, সেরোটিক, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে ব্যবহৃত হয়।

শাপলা তরকারি হিসেবে খুবই মজাদার একটি খাদ্য। গত কয়েক বছর যাবৎ এ ব্যবসাটি শ্রীপুরে বেশ প্রসার লাভ করেছে। এ থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে এখন অনেকেই সংসার চালাচ্ছেন। এর সাথে জড়িতরা কৃষিতে নতুন একটা দিগন্ত সৃষ্টি করার মতো উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।

সোনালী বার্তা/এমএইচ


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
এক ক্লিকে বিভাগের খবর