বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:২৯ পূর্বাহ্ন

কমিউনিটি ক্লিনিক বিনামূল্যে মিলছে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ, উপজেলায় যেতে অনীহা

মোঃ রমজান আলী, রাজশাহী / ৩২ Time View
Update : মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪

দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সরকারিভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পায় সাধারণ মানুষ। এসব ক্লিনিকে বিভিন্ন রোগের মোট ২২ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহ করে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ। কিন্তু ওষুধ পেতে হলে যেতে হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখান থেকে লিখে দিলেই মেলে ওষুধ। এতেই চরম অনীহা মানুষের।

সরেজমিনে রাজশাহী বিভাগের পবা উপজেলার নওহাটা ইউনিয়নের কুমড়া পুকুর কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে এসেছেন আরিফা বেগম। বয়স ৩৭ বছর। প্রায় ১৫ বছর ধরে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস আক্রান্ত তিনি।
প্রতি মাসে ওষুধের পেছনেই ব্যয় হতো ছয় হাজার টাকা। কৃষক পরিবারের স্বল্প আয়ে সে ব্যয় মেটানো কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। তবে সরকারি উদ্যোগে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে বিনামূল্যে ওষুধ ও পরামর্শের পর তার কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়েছে। এজন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে হলেও তার খরচ কমেছে দুই-তৃতীয়াংশ।

বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) সকালে কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) মো. মশিউর রহমান জানান, কমিউনিটি ক্লিনিকটিতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও অসংক্রামক রোগের প্রায় ২২ ধরনের ওষুধের সরবরাহ রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ এলেও এখনো সাধারণ মানুষকে দেওয়া শুরু হয়নি। এজন্য এলাকার রোগীদের পবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে হচ্ছে।
ক্লিনিকে আসা রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডায়াবেটিসের ওষুধ তারা এই ক্লিনিকে পান। কিন্তু উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের জন্য যেতে হয় উপজেলায়। এতে সময় বেশি লাগছে আবার ব্যয়ও বেড়েছে। যদি গ্রামের ক্লিনিকেই উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের সরাসরি সরবরাহ থাকতো তাহলে সময় ও অর্থ বেঁচে যেত।

বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) সকালে কুমড়াপুকুর কমিউনিটি ক্লিনিক ও পবা উপজেলার হুজুরিপাড়া ইউনিয়নের তেতুলিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকে সরেজমিনে দেখা যায়, ক্লিনিকে অন্তত ১৫ জন উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের চিকিৎসা নিতে এসেছেন। দুই ক্লিনিকেই উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ মিলছে না। সেন্টারে পৌঁছালেও উপজেলার ব্যবস্থাপত্র ছাড়া রোগীদের দিচ্ছে না ক্লিনিকগুলো।

হুজুরিপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) মফিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ক্লিনিকটিতে প্রতিদিন অন্তত ৩০-৪০ জন মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, কৈশোরকালীন সেবা, নবজাতক ও গর্ভবতী নারীরা সেবা নিতে আসেন। এর বাইরে অসংক্রামক রোগাক্রান্ত (উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস) মানুষ ওষুধ ও পরামর্শের জন্য আসেন। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে রোগীদের লিখে দিলে আমরা তাদের দেই।

ক্লিনিকের বারান্দায় কথা হয় সাত বছর ধরে উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত চানমুন খাতুনের (৪৩) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাড়ির কাজ ফেলে ছয়-সাত কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে (উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স) যাওয়া আমাদের জন্য একটু কঠিন। অনেক সময় ওষুধ শেষ হলেও হাসপাতালে যাওয়া হয় না। পরে অসুস্থ হয়ে পড়ি। সরকার যেহেতু আমাদের মতো গরিব মানুষের জন্য বাড়ির কাছে কমিউনিটি ক্লিনিক বানিয়েছে সেখানে সরাসরি এই ওষুধ দেওয়ার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।

গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্ট্যাডিজের ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের প্রধান তিনটি কারণের একটি উচ্চ রক্তচাপ। তথ্যমতে, রাজশাহী জেলার ১১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (এনসিডি) কর্নার থেকে ২২ হাজার ৫০৩ জন উচ্চ রক্তচাপের রোগী চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। এর মধ্যে শুধু উচ্চ রক্তচাপের রোগী ১২ হাজার ৮শ এবং উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস উভয় রোগাক্রান্ত ৯ হাজার ৭০৩ জন। এছাড়া ৮ হাজার ৬৬০ জন শুধু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী এনসিডি কর্নার থেকে চিকিৎসাসেবা পান।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে দেশে অকাল মৃত্যুও কমে আসবে। কারণ মৃত্যুর প্রধান তিন কারণের অন্যতম উচ্চ রক্তচাপ। যদি অকাল মৃত্যু কমাতে হয় তাহলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে।-অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী

সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ জেলায় উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের হার ছিল শতকরা ৫৬ শতাংশ। তবে উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের মধ্যে ২৭ শতাংশ রোগী নিয়মিত চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন না। রাজশাহীতে ২৩৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। তার মধ্যে ২১৬টি ক্লিনিকে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের দুটি ওষুধের সরবরাহ রয়েছে। জেলার মোহনপুর উপজেলার ২০টি কমিউনিটি ক্লিনিক এই দুই রোগের ওষুধ পায়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৮ সাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এনসিডিসি) ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ দেশের ২৩ জেলার ১৮২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং চারটি সদর হাসপাতালের এনসিডি কর্নারে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। যার উদ্দেশ্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত করা, চিকিৎসা ও ফলোআপ কার্যক্রম শক্তিশালী করা।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে তৃণমূল পর্যায়ে প্রকল্পটি আরও সফল করতে পরীক্ষামূলকভাবে সিলেট জেলার চারটি উপজেলার (গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিশ্বনাথ ও বিয়ানীবাজার) ৮৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে সরকারিভাবে বিনামূল্যে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ দেওয়া শুরু হয়। উচ্চ রক্তচাপের ক্রমবর্ধমান প্রকোপ মোকাবিলায় কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের (সিসিএইচএসটি) কমিউনিটি ক্লিনিকে ব্যবহৃত ওষুধের তালিকা হালনাগাদকরণ কমিটির সভা হয়। গত বছর ১৪ মে ওই সভায় কমিউনিটি ক্লিনিকের ওষুধ তালিকায় উচ্চ রক্তচাপের জন্য অ্যামলোডিপিন ৫ মিলি গ্রাম ও ডায়াবেটিসের জন্য মেটফরমিন ৫০০ মিলি গ্রাম সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

এরই মধ্যে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ উপজেলার কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দেশব্যাপী এ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা গেলে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং স্বল্প খরচেই হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনি বিকল হওয়ার মতো ব্যয়বহুল রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে অসংখ্য জীবন বাঁচানো যাবে।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, ‘হৃদরোগজনিত অসুস্থতার অন্যতম কারণ উচ্চ রক্তচাপ। তৃণমূল পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে হৃদরোগের প্রকোপ কমানো সম্ভব।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ‘উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে দেশে অকাল মৃত্যুও কমে আসবে। কারণ মৃত্যুর প্রধান তিন কারণের অন্যতম উচ্চ রক্তচাপ। যদি অকাল মৃত্যু কমাতে হয় তাহলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, সরকারের তো একটা টার্গেট আছে অকাল মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা। এজন্য ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। প্রান্তিক পর্যায়ে ওষুধ কিনে খেতে না পারলে ওষুধ সরবরাহ করা সরকারের দায়িত্ব।

ডা. সোহেল রেজা বলেন, ‘এটা দুভাবে করা যায়। প্রথমত, কেন্দ্রীয়ভাবে ইডিসিএল থেকে কেনা। এখান থেকে কেনাকাটায় বড় জটিলতা আছে। তারা ঠিক সময়মতো ওষুধ বানাতেও পারে না আবার কিনে যে সাপ্লাই দেবে সেটাও অনেক চ্যালেঞ্জিং। এটা ঠিক করতে হবে। দ্বিতীয়ত, উপজেলা পর্যায়ে ওষুধ কেনার ক্ষমতা বাড়াতে হবে।

সোনালী বার্তা/এমএইচ


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
এক ক্লিকে বিভাগের খবর