রাসিকের নান্দনিক ফুটওভার ব্রিজে উঠেন না পথচারী: টিকটকারদে ভিড়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নগরীর বিনোদপুর বাজার এলাকা। এ বাজারের উত্তর পাশের এবং দক্ষীণ পাশে রাস্তা পারের জন্য সম্প্রতি নির্মাণ করা হয়েছে ৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ফুটওভার ব্রিজ। গত ১১ সেপ্টেম্বর নগরীতে নির্মাণ শেষ হওয়া নান্দনিক ৬টি ফুটওভার ব্রিজ উদ্বোধনের দিন বিনোদপুর বাজারের এ ব্রিজটিও উদ্বোধন করা হয়।
ব্রিজের নিচের ফল ব্যবসায়ী মাসুদ রানা বলেন, তাও একমাস হয়ে গেলো এই ব্রিজ দিয়ে একজন লোককেও পার হইতে দেখিনি। তবে মাঝে মাঝে দুই-একজনকে দেখি নানা অঙ্গি-ভঙ্গি করে ভিডিও করতে আর ছবি তুইলতে। এরা সবাই উঠতিবয়সের ছেলে-মেয়ে। ওরা নাকি টিকটক করে। সাধারণ মানুষ উতো উঁচু ব্রিজে দিয়ে পারাপর হবি ক্যা? নিচ দিয়েই তো আরামে যাওয়া যায়। তাহলে কষ্ট করে ওত উঁচু দিয়ে উঠবে ক্যা।
একই অভিমত পাশের সবজি ব্যসায়ী নজরুল ইসলামের। তিনিও দাবি বলেন, কেউ তো উঠে না। তাহলে এতো রং-চং দিয়ে কোটি কোটি ট্যাক খরচ করে কি বুইলছিল এইরকম পায়ে হাঁটা ব্রিজ করতে? আসলে সরকারি টাকা লুটপাটের জন্য এসব ব্রিজ করা হছে। মানুষের কোনো কাজে আসে না।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শুধু বিনোদপুরের এই ব্রিজটায় নয়, রাজশাহী নগরীর নিউ গভর্মেন্ট ডিগ্রী কলেজ গেট, লক্ষীপুর মিন্টু চত্ত্বর, নওদাপাড়া বাজার, তালাইমারী মোড়, বিনোদপুর মোড় ও অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে নির্মাণ শেষ হওয়া ৬টি ফুটওভার ব্রীজের একটি দিয়েও মানুষ চলাচল করে না। ফলে কোনোই কাজে আসছে না এ ব্রিজগুলো। এর অন্যতম কারণ হলো প্রতিটি রাস্তার বিভাজক রয়েছে শুধুমাত্র নামেমাত্র। যেসব স্থানের বিভাজকে লোহা বা স্টিলের গ্রিল আছে, তার মাঝখান দিয়েও রয়েছে রাস্তা পারের স্থান। আবার ফুটওভারের ব্রিজের নিচে রাস্তার অধিকাংশ স্থানই ফাঁকা। যার কারণে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হলেও সেখান দিয়ে পথচারীরা চলাচল করছেন না।
রাসিক সূত্র মতে, রাজশাহী নগরীতে ৮টি ফুটওভার নির্মাণকাজ হাতে নেয় রাসিক কর্তৃপক্ষ। পথচারীদের রাস্তা পারাপারের জন্য সদ্য বিদায়ী মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের সময়ে এ ব্রিজগুলো নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তিনি বিদায় হওয়ার মুহূর্তে ৬টির কাজ শেষ হলেও উদ্বোধন করতে পারেননি। আর নগরীর মনিচত্বর ও মিশন গার্লস স্কুলের সামনে আরও দুটি ফুটওভার ব্রিজের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে।
নগরীর সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় দুইটি প্যাকেজে প্রায় ৫০ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয়ে এসব ফুটওভার ব্রীজ নির্মাণ করা হচ্ছে। নির্মাণকাজ পেয়েছে মাসুদ স্টিল ডিজাইন বিডি লি. ও এমএসসিএল এ্যান্ড এমএসডিবিএল নামের দুটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি ফুটওভার ব্রীজের উচ্চতা ৫.৮ মিটার ও প্রশস্ততা ৩.৬ মিটার। ফলে অনেক উঁচুতে পায়ে হেঁটে উঠে রাস্তা পার হয়ে আবার নিচে নামার জন্য কেউ এই ব্রিজ ব্যবহার করছেন না। রাস্তার মাঝখান দিয়েই পারাপার হচ্ছেন পথচারীরা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রাকিব হাসনাইন বলেন, ব্রিজের নিচ দিয়ে রাস্তা পারাপারের জন্য যথেষ্ট জায়গা আছে। তালাইমারীর এই মোড়টা গোটায় ফাঁকা। সড়ক বিভাজকেও নাই গ্রিল। যার কারণে কেউ ভুল করেও ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করে না। আর রাজশাহীর শহরে এতো গাড়ির চাপও নাই যে গাড়ীর ভয়ে মানুষ ফুটওভাব ব্রিজ দিয়ে কষ্ট করে রাস্তা পার হবে। এমনিতেই রাস্তা পার হতে যেখানে লাগে সর্বোচ্চ ১০ সেকেন্ড। সেখানে ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে গেলে লাগবে অন্তত দেড় মিনিট। তাহলে কে উঠবে ওই ব্রিজে। কোনো সম্ভাবতা যাচাই-বাছাই না করেই এই ব্রিজগুলো নির্মাণ করা হয়েছে শুধুমাত্র সরকারি অর্থ অপচয় করার জন্য।
রাজশাহী নিউ গর্ভমেন্ট ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী আলী আশরাফ বলেন, সাধারণত পথচারী তো দূরের কথা একজন শিক্ষার্থীও যাতায়াত করে না এই ব্রিজে দিয়ে। তবে যারা টিক টক করে বা কেউ শখের বসে ছবি তুলতে উঠতে দেখি।
রাসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এবিএম শরীফ উদ্দিন বলেন, ঢাকা শহরে মানুষ যানজটের মধ্যেও এমন ফুটওভার ব্রিজ সহজে ব্যবহার করে না। সেখানে রাজশাহীর মানুষ এগুলো ব্যবহারে এতো দ্রুত অভ্যাস্ত হবে-সেটা ভাবা যায় না। তার পরেও এগুলো ব্যবহারে সাধারণ মানুষকে অভ্যাস করতে ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে যুক্ত পুলিশ সদস্যদের কাজ করতে হবে।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. এমএসটি ইলমে ফরিদতুল বলেন, ‘এগুলো নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা আগামীতে থাকতে পারে। তবে এখন এগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের যেখানে সমস্যা নেই, সেখানে আগাম সমাধানের দরকার কী? এগুলো বানানোর সময় প্লানিং ও ট্রাসপোর্ট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কেউ ছিল না বলেই এগুলো মিসিং হয়েছে। একারণেই এগুলো মানুষ ব্যবহার করছে না।
রাসিকের প্রশাসক ও রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, ফুটওভার ব্রিজ ব্যহারে মানুষ এখনো অভ্যাস্ত নয়। তবে যেটি হয়ে গেছে, সেটি আর তো নষ্ট করা যাবে না।’ এগুলো ব্যবহারের উপযোগী করতে আমরা কাজ করছি। নির্মাণেও কিচু ত্রুটি আছে।
সোনালী বার্তা/এমএইচ