বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৫০ অপরাহ্ন

সমুদ্রে বিপুল সম্ভাবনার হাতছানি

নিজস্ব প্রতিবেদক / ২৪ Time View
Update : সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০২৪

বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ তার মূল ভূখণ্ডে ৮১ শতাংশ পরিমাণ রাষ্ট্রীয় জলসীমা অর্জন করেছে। অর্থাৎ সমুদ্রে মোট ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার জলরাশির জল, সমুদ্রতল ও অন্তমৃত্তিকায় বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এই অর্জন দেশের সাগর ও উপকূলীয় অঞ্চলে সব ধরনের সমুদ্রসম্পদ আহরণ, বাণিজ্যিক জাহাজ, জ্বালানি, পর্যটন ইত্যাদি ঘিরে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।

জানা যায়, সমুদ্রাঞ্চলে গ্যাস হাইড্রেট ও মেরিন জেনেটিক রিসোর্সের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১২ ও ২০১৪ সালের মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণসংক্রান্ত বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তির ফলে এখন এই অপার সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট সুনীল অর্থনীতির উন্নয়নকে বেগবান করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক, বাণিজ্যিক ও পরিবেশগত প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণপূর্বক সুনির্দিষ্ট ৯টি খাত চিহ্নিত করেছে। ১. সামুদ্রিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা, ২. সামুদ্রিক মৎস্যচাষ উন্নয়ন, ৩. বাণিজ্যিক নৌপরিবহনের উন্নয়ন, ৪. সমুদ্রভ্রমণ পর্যটনের বিকাশ সাধন, ৫. অফশোর ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও সুনীল বায়োটেকনোলজি গবেষণা ও উন্নয়ন, ৬. জাহাজ নির্মাণ ও রিসাইক্লিং শিল্প সম্প্রসারণ, ৭. স্থিতিশীল জীবিকার জন্য ম্যানগ্রোভের বাস্তুসংস্থানগত সেবা, ৮. সামুদ্রিক দূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ, ৯. মেরিন স্পেশিয়াল প্ল্যানিং বাস্তবায়ন।

সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের মতামত ও সুপারিশের ভিত্তিতে ‘সুনীল অর্থনীতি উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা’ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের অধীনে ব্লু-ইকোনমি সেল কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।

মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের প্রতিনিধিসহ নেদারল্যান্ডসভিত্তিক গবেষক ২০২০ সালে বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় মাঠ পর্যায়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে। উক্ত গবেষণা থেকে বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক এলাকায় (ইইজেড) এমজিআরের সার্বিক অবস্থান চিহ্নিত করা, বিবিধ প্রজাতি চিহ্নিত করাসহ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করে।

সেই ফলাফলের ভিত্তিতে বাংলাদেশে ২২০ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, পাঁচ প্রজাতির লবস্টার, ছয় প্রজাতির কাঁকড়া, ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস ইত্যাদি চিহ্নিত করা হয়।

পরবর্তী সময়ে এসব প্রজাতির ওপর প্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরি টেস্ট নেদারল্যান্ডসে সম্পন্ন করা হয়। কোভিড-১৯-জনিত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গবেষণা কার্যক্রমে সাময়িক বিরতির পর ২০২১ সালে তা পুনরায় শুরু হয়। ওই কার্যক্রমে বিশেষ করে বাংলাদেশে সামুদ্রিক শৈবালের সম্ভাবনা ও বাণিজ্যিকীকরণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রাপ্ত বহুসংখ্যক প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবালের মধ্যে কয়েকটি প্রজাতির ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে, যা বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

দেশের সমুদ্রাঞ্চলে সম্ভাবনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স ফ্যাকাল্টি অব ফিশারিজ, একুয়াকালচার অ্যান্ড মেরিন সাইন্সের অধ্যাপক ড. কাজী আহসান হাবীব বলেন, আমাদের সমুদ্রের যথাযথ ব্যবহার এবং ব্যবস্থাপনা দরকার। আমাদের সমুদ্র সীমানায় কিছু জায়গায় সামুদ্রিক শৈবাল (seaweed) কালচার শুরু হয়েছে। আরও বড় পরিসরে সামুদ্রিক শৈবালের চাষের সম্ভাবনাগুলো খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি সামুদ্রিক শামুক ঝিনুকও আমরা চাষের আওতায় আনতে পারি। এগুলো রপ্তানি করে বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের মানুষ সি-উইড খাওয়ায় অভ্যস্ত না হলেও, সি-উইড এক্সট্র্যাক্ট থেকে অনেক কিছুই বানানো যায়, যেমন আগার আগার। ওষুধ শিল্পের কাচামালও সি-উইড থেকে পাওয়া যায়। বায়োটেকনোলজি ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরণের সি-উইড, মেরিন ব্যাক্টেরিয়া থেকে আমরা ওষুধ তৈরি করতে পারি।

সমুদ্রাঞ্চলে সম্ভাবনা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে এখন যেটা করা হচ্ছে, সেটা কোস্টাল একুয়া কালচার, মেরিন কালচার এখনও সেইভাবে শুরু হয় নাই। আমাদের সমুদ্র সীমায় অনেক ভালো এবং দামি মাছ আছে, বিদেশে সেগুলোর চাহিদাও অনেক। আমরা সেগুলোকে কালচারের আওতায় আনতে পারি নাই। এসব মাছের বিডিং পদ্ধতি বের করে সমুদ্রে চাষ করা যেতে পারে। আমাদেরকে সমুদ্র বিষয়ে আরও বেশি গবেষণা বাড়াতে হবে, সমুদ্রে নতুন নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে হবে। সমুদ্র অঞ্চলে সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারলে একদিকে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে, পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন হবে।

অপরদিকে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অধিকৃত জলসীমায় সমুদ্রে ও তলদেশে গ্যাস-হাইড্রেটের উপস্থিতি এবং এর অবস্থান, প্রকৃতি ও মজুদের ব্যাপারে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেছে।

২০১২ সালে ভারত ও ২০১৪ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। ইতোমধ্যে প্রতিবেশি দুই দেশই সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলন শুরু করেছে।

সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে গত ১০ মার্চ আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। এরই মধ্যে দরপত্র কিনেছে সাতটি বহুজাতিক তেল-গ্যাস কম্পানি। শর্ত শিথিল করে আরো প্রতিষ্ঠানকে নিলামে টানার পরামর্শ দিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। সেই সঙ্গে বছরে বিনিয়োগের ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ফেরত পাওয়ার সুযোগসহ উৎপাদন-অংশীদারি চুক্তির বেশ কিছু ধারা সংশোধনের তাগিদও দিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের চুক্তিগুলো মোটামুটি ঠিক আছে। বিদেশি কোম্পানিগুলো যেনো দরপত্রে অংশগ্রহন করে সেই জন্য কিছু শর্ত শিথিল করা হয়েছে। এর আগে আমরা দুই তিনবার ফেল করেছি। এর আগে সরকার কতটা সিরিয়াস এবং সিনসিয়ার ছিল সেটাও একটা বিষয়। আমরা ইতিমধ্যে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে প্রায় ১০ বছর পিছিয়ে গিয়েছি। এর আগে চুক্তির শর্তগুলো এমন ছিল যে কেউ আর আগ্রহ দেখায়নি। কাজটা যেন হয়, সেইভাবেই এবার শর্তগুলো দেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসম্পদের ব্যবহারে যথাযথ উদ্যোগ এবং বাবস্থাপনা বাংলাদেশকে আগামী দিনের জ্বালানি নিরাপত্তা যেমন দিতে পারে, তেমনি বদলে দিতে পারে সামগ্রিক অর্থনীতির চেহারা। এমনকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে সামুদ্রিক খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে সেখান থেকে আরও বেশি মাছ আহরণ করাও সম্ভব।

সোনালী বার্তা/এমএইচ


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
এক ক্লিকে বিভাগের খবর