গাছ কমায় সোনারগাঁয়ে খেজুরের রস সংগ্রহে ভাটা

দিন যায়, রাতে আসে আবার রাত যায় আসে দিন। এভাবেই দিনের পর দিন সোনারগাঁসহ নারায়ণগঞ্জজুড়ে কমছে খেজুরের গাছ। ফলে কমে যাচ্ছে খেজুরের রস সংগ্রহ। এমন পরিস্থিতিতেও কেউ কেউ ঐতিহ্য ধরে রাখতে বেঁচে থাকা গাছগুলো থেকে রস সংগ্রহ করেন। কিন্তু তাতেও আছে বিপত্তি, প্রতিদিনই কোনো না কোনো গাছ থেকে রস চুরি হয়। এতে কমছে সংগ্রহ। সরবরাহেও হচ্ছে সমস্যা।
নারায়ণগঞ্জের খেজুরের গাছ কমে যাওয়ার কারণ নগরায়ন। গাছিরা বলছেন, নগরায়নের ফলে খেজুরের গাছ কমে যাওয়ায় তাদের খেজুরের রস সংগ্রহ করার পরিমাণও কমে গেছে। তা ছাড়া আরেক কারণ হচ্ছে হাড়িসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গের দাম বেড়ে যাওয়া।
আরও পড়ুন: আওয়ামী লীগের লিফলেট বিতরণকালে আটক ২
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সনমান্দী এলাকার বাসিন্দা সরওয়ার শেখ (৫৫)। যিনি তিন যুগের বেশি সময় ধরে শীতকালে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজ করছেন। তিনি জানান, আগে খেজুরের রস সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি অথবা গুড় বানানোর কাজ বেশি করতেন। এখন গাছ কমে যাওয়ায় রস সংগ্রহ হয় অল্প। তাই গুড় তৈরি না করে বাজারে বিক্রি করে দেন। সরওয়ার শেখ বলেন, একযুগ আগেও গ্রামের বড় বড় বাড়িগুলোয় প্রচুর খেজুর গাছ ছিল। এক বাড়ি থেকেই ২০-৩০ লিটার খেজুর রস সংগ্রহ করা যেত। তখন একদিন গাছ মালিককে রস দিয়ে একদিন গাছি নিতো। এখন পাঁচ গ্রাম ঘুরেও ২০টি খেজুর গাছ পাওয়া যায় না।
গাছ মালিককে তিনভাগের একভাগ দিয়েও শ্রমের মজুরি তোলা যায় না। নগরায়ন, দালানকোঠা ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মানের ফলে খেজুর গাছসহ গ্রামের বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সংখ্যা কমেছে। নতুন করে আম, কাঁঠাল, নারিকেলসহ অন্যান্য ফলের গাছ লাগালেও এখন কেউ খেজুর গাছ রোপণ করতে চায় না। ফলে এ অঞ্চলে খেজুর গাছের সংখ্যা কমছেই। তবে শুধু গাছ কমে যাওয়া নয়, চুরি ও হাড়িসহ প্রয়োজনীয় মালামালের দাম বৃদ্ধির কারণেও শীতে রস সংগ্রহে অনীহা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলার আড়াইহাজার উপজেলার বাসিন্দা ও গাছি আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, ২০-২৫ বছর ধরে অগ্রহায়ণ মাসের শুরুতে খেজুর গাছ বাছাইয়ের কাজটি শুরু করেন।
আরও পড়ুন: গাজীপুরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খালে পিকআপ, নিহত ৩
এরপর গাছের বাকল ছিলে রস সংগ্রহ শুরু করেন। তবে আগের মতো এখন খেজুর গাছ নেই। গাছ না থাকার পাশাপাশি রস চুরি, হাড়িসহ প্রয়োজনীয় মালামালের দাম বৃদ্ধির কারণে এখন তেমন কেউ এ কাজে আগ্রহ প্রকাশ করেন না। আগে প্রচুর গাছ থাকলেও এখনকার মতো রস চুরি হতো না। এখন রাস্তার পাশের গাছে হাঁড়ি ঝোলালেই সেটি রসসহ চুরি হয়ে যায়। এতে করে আর্থিক লোকসান হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, গাছ মালিকের ভাগের রস দিতে হয় এটাই নিয়ম, তার ওপর চুরি হলে সে লোকসানও গাছির হয়। তাই সড়কের পাশ থেকে বাড়ির ভেতরের গাছ হলে তা থেকে রস সংগ্রহ নিরাপদ। তবে সেই রস সংগ্রহেও গাছের নিচে কাটা দিয়ে রাখতে হয়। আবার রসের হাঁড়িতে যাতে বাদুড় মুখ না দেয় সেজন্য নেট বা মশারির কাপড় দিয়ে দিতে হয়। এতকিছু করে রস সংগ্রহের কাজে কারও আগ্রহ দেখা যায় না। আমি এখন শখের বসে রস সংগ্রহ করি। প্রতিদিন বিকেলে হাড়ি গাছে ঝুলিয়ে দিই, ভোরে নামিয়ে বাজারে নিয়ে যাই।
আগে হাড়ি প্রতি রস বিক্রি হলেও এখন লিটার প্রতি ১৫০-১৬০ টাকায় বিক্রি হয় জানিয়ে তিনি আরও বলেন, রসের মূল্য আর সরবরাহ কমের কারণে এখন গুড় তৈরি কমে বাজারে লিটার প্রতি বিক্রি হয়। তবে সেই রসেরও চাহিদা অনেক। কারণ, কাঁচা রস খাওয়ার চেয়ে এই সময়য়ে রসে ভেজানো পিঠার কদর থাকে বেশি। শীতের সকালে প্রতিদিন বাড়ির উঠানে চাচাদের দেখতাম রসের হাঁড়ি গাছ থেকে নামিয়ে এক জায়গা করতেন। তারপর সেই রস ছেঁকে আমাদের খেতে দিতেন।
এমআর/