শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ০৫:২০ অপরাহ্ন

নাজমা-অপুর কাছে এখনো জিম্মি যুব মহিলা লীগ

মোক্তাদির হোসেন প্রান্তিক / ৮৯৬ Time View
Update : মঙ্গলবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী যুব মহিলা লীগ। দুই দশক ধরে নেতৃত্ব ধরে রেখেছিল নাজমা আক্তার ও অপু উকিল। তাই ছাত্রলীগ থেকে বিদায় নেওয়ার পর যুব মহিলা লীগ করতে আসা নেত্রীরা যেন নেতৃত্ব জটে আটকে পড়ে থাকে। তাদের বয়স বাড়লেও নেতৃত্বে গতিশীল পরিবর্তন হয় না সহজে। তবে প্রতিষ্ঠার শুরুতে আওয়ামী যুব লীগ সর্বক্ষেত্রে যে আবেদন অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল; সময়ের ব্যবধানে সংগঠনটির নেত্রীদের বিতর্কিত-অনৈতিক কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে উঠার ঘটনা এবং দলের ভেতরে-বাইরে ‘চেইন অব কমান্ড’ না থাকায় আওয়ামী লীগকে বার বার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে।

সবশেষ আওয়ামী যুব মহিলা লীগের নেতৃত্ব আসেন আলেয়া সারোয়ার ডেইজী ও শারমিন সুলতানা লিলি। নেতৃত্বে পরিবর্তন হলেও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দলের ধারাবাহিকতার অবসান ঘটেনি। বরং তার চেয়ে বেশি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দলকে নিয়েই চলছে যুব মহিলা লীগের কার্যক্রম।

সংগঠনের প্রতিষ্ঠার শুরুতে নাজমা আক্তার ও অপু উকিল দুজনই যতটা সময় ব্যয় করেছেন সংগঠনের স্বার্থে তার চেয়ে বেশি নিজেদের ‘মাইম্যান’ তৈরিতে লম্বা সময় নেতৃত্ব ধরে রেখেছিলেন। তাদের সেই কমিটির দ্বন্দ্ব-কোন্দল জিইয়ে রেখে এখনো তারাই আওয়ামী যুব মহিলা লীগের নেতৃত্বের ওপর প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছেন। কেননা সাবেক সভাপতির অনুসারী হিসেবে পরিচিত শারমিন সুলতানা লিলি এখন যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাকের দায়িত্ব পালন করছেন।

অন্যদিকে, সাবেক সাধারণ সম্পাদক অপু উকিলের অনুসারী হিসেবে যুব মহিলা লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন আলেয়া সারোয়ার ডেইজী। তাদের মধ্যে নেতৃত্বে প্রতিযোগিতায় দ্বন্দ্ব-কোন্দল বিরাজমান। যার ফলে সংগঠনের স্বকীয়তা দুজনের নেতৃত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হতে পারছে না। আওয়ামী যুব মহিলা লীগ মানেই ‘সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক’। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী যুব মহিলা লীগের বেশ কয়েকজন নারী নেত্রী সোনালী বার্তাকে এমনটাই জানিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ৭ম তলায় যুব মহিলা লীগের সভাপতি আলেয়া সারোয়ার ডেইজী ও সাধারণ সম্পাদক শারমিন সুলতানা লিলি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। সাক্ষাতকালে যুব মহিলা লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক অভিযোগ করেন, ‘আমরা যুব মহিলা লীগের দায়িত্ব পেয়েছি। কিন্তু সাংগঠনিকভাবে সংগঠনের জন্য কিছু করতে পারছি না। সংগঠনের প্রতিটি কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যাচ্ছেন যুব মহিলা লীগের সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক (নাজমা আক্তার ও অপু উকিল)। সাবেক এই দুই নেত্রী নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যুব মহিলা লীগের নেতাকর্মীদের নিজেদের বলয়ে ধরে রেখে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়; সম্প্রতি সংগঠনটির সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক দুজন ঢাকা মহানগর (উত্তর-দক্ষিণ) যুব মহিলা লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গণভবনে যান। যা যুব মহিলা লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অজানা। আর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর থেকে মহানগর যুব মহিলা লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেত্রীরা কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মানতে চাচ্ছেন না।

এ সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে উদ্দেশ্য করে যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শারমিন সুলতানা লিলি বলেন, কমিটির দায়িত্ব পেলাম, চেয়ার পেলাম কিন্তু সংগঠন চালাতে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। কোনো কমিটি দিতে পারছি না। শুধুমাত্র পদ-পদবি ধরে রাখতে নেতৃত্ব চাই না। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই, তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ করে দেন। অন্যথায় এখনই রিজাইন দেব।

তখন উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, সুজিত রায় নন্দী, উপ-দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান, কৃষক লীগের সভাপতি সমীর চন্দ্র, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন প্রমুখ।
তবে যুব মহিলা লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে আশ্বস্ত করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আমি মাননীয় নেত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তুলে ধরব, কথা বলব। প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে তোমাদেরকে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যও নিয়ে যাওয়া হবে।

এ সময় জামালপুরে যুব মহিলা লীগের একটি প্রোগ্রামের বিষয় তুলে ধরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, ‘নাজমা-অপু কমিটির একটি প্রোগ্রামে আমি উপস্থিত ছিলাম। একপর্যায়ে আমি বললাম- তোমাদের প্রোগ্রামে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আছেন, সভাপতি থাকলে আরও ভালো হতো.. তখন স্থানীয় একজন যুব মহিলা লীগ নেত্রী আমায় জানান- নাজমা আক্তার ও অপু উকিল দুজনে ৩২ জেলা করে ভাগাভাগি করেছেন। ৩২ জেলা কমিটিসহ সার্বিক বিষয় দেখবেন নাজমা আক্তার, পক্ষান্তরে ৩২ জেলার কমিটিসহ অন্যান্য বিষয় দেখভাল করবেন অপু উকিল।’

প্রতিউত্তরে মির্জা আজম বলেছিলেন, এভাবে তো একটি সংগঠন চলতে পারে না।

আওয়ামী যুব মহিলা লীগের দায়িত্বে নেই নাজমা আক্তার ও অপু উকিল। কিন্তু দলের ভেতরে-বাইরে আলোচনা-সমালোচনার গুঞ্জন যে, এখনো (নাজমা-অপু) তাদের তৈরি সিন্ডিকেটের সঙ্গে পেরে উঠছেন না যুব মহিলা লীগের নেতৃত্ব। বরং নাজমা-অপু’র অদৃশ্য সুতায় বন্দি হয়ে আছে যুব মহিলা লীগের ভবিষ্যত রাজনীতি?

এ বিষয়ে আওয়ামী যুবলীগের সভাপতি আলেয়া সারোয়ার ডেইজী সোনালী বার্তাকে বলেন, যুব মহিলা লীগের সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের শতভাগ প্রতিবন্ধকতায় আটকে আছে যুব মহিলা লীগের ভবিষ্যত রাজনীতি। কথাটা শতভাগ সত্য কথা। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্শেনায় যার যার এলাকায় নির্বাচনী কাজে অংশগ্রহণ করেছি। সাংগঠনিক ভাবে মিটিং মিছিল করেছি। আর আমরা গত শুক্রবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাকের কাছে এই বিষয়টি অবহিত করেছি। এমনও বলেছি- নেত্রীর (প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে কথা বলেন। কাজ করার সুযোগ না পেলে আমরা সাক্ষাৎ করে নেত্রীর কাছে মাফ চেয়ে সংগঠন থেকে বিদায় নেব। আর কাজ করার স্বাধীনতা দিলে সারাদেশে যুব মহিলা লীগের উদ্দীপনা দেখিয়ে দেব। রাজনীতি করতে গিয়ে কষ্ট করছি, অর্থ ব্যয় করেছি, পরিবার-পরিজন থেকে দূরে পড়ে আছি। কিন্তু রাজনীতির সাংগঠনিক কাজ করার সুযোগ পাচ্ছি না।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক লিলির সঙ্গে আমার সখ্যতা ও বোঝাপড়া আন্তরিক। সে বয়সে ছোট, আমি তাকে স্নেহ করি এবং আমাকেও সে সম্মান করে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নেই বরং আমি তাকে বলেছি- তোমার বয়স কম, তোমার সামনে রাজনীতির লম্বা সময়। এক সময় তুমি এই সংগঠনের সভাপতি হবে। এমনকি ভবিষ্যতে সংসদ সদস্যও হবে। তাই মনোযোগ দিয়ে কাজ করো সফলতা আসবেই।

এদিকে, ডেইজী-লিলির নেতৃত্বে কমিটি গঠনের পর পরই আওয়ামী যুব মহিলা লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল সামাজিকত যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছিলেন- ‘বাংলাদেশ যুব মহিলা লীগের নবনির্বাচিত নেতৃবৃন্দের প্রতি ফুলেল শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন রইল। তোমরাই সংগঠনের আগামী দিনের আলোক বর্তিকা। প্রিয় সংগঠন এগিয়ে যাক সম্মুখপানে।’

তবে সভাপতি আলেয়া সারোয়ার ডেইজী ও সাধারণ সম্পাদক শারমিন সুলতানা লিলি দায়িত্ব নেয়ার পর কেন্দ্র থেকে শুরু করে হাতেগোনা কয়েকটি নতুন কমিটি ছাড়া তেমন সফলতার সাক্ষর দেখাতে পারেনি যুব মহিলা লীগ। রাজপথের কর্মসূচিতেও তাদের খুব একটা দেখা মেলেনি। এমন কি তাদের কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মানতে নারাজ ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ যুব মহিলা লীগের দায়িত্বে থাকা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরাও।

জানতে চাইলে যুব মহিলা লীগের সভাপতি আলেয়া সারোয়ার ডেইজী বলেন, ঢাকা মহানগর (উত্তর-দক্ষিণ) আওয়ামী যুব মহিলা লীগের সভাপতি দুজন সাবেক সভাপতি নাজমা আপার নিজস্ব লোক। আর ঢাকা মহানগর (উত্তর-দক্ষিণ) যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক দুজনেই সাবেক সাধারণ সম্পাদক অপু দি’র মনোনীত লোক। দীর্ঘ প্রায় ২২ বছর ধরে তারা স্বপদে বহাল আছেন। ফলে আমারে সঙ্গে কিছু দূরত্ব আছে। নেতৃত্ব মানতে নারাজ। তাদের নেতৃত্বে এখনো নাজমা আপা ও অপু দি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অপু দিদিকে আজীবন সম্মান করি, করব। তার অনুসারী, কিন্তু তার মানে এই নয়; সংগঠন চালাতে গিয়ে তার হস্তক্ষেপ মেনে নিয়ে সংগঠনকে দুর্বল থেকে দুর্বল করব। রাজনীতি করতে গেলে ভাই-বোনের মধ্যে সম্পর্কেও অবনতি হয়, সেখানে রাজনৈতিক ‘সহযোদ্ধা’। আমি ব্যক্তি এক তবে যখন কোনো দায়িত্ব নিয়ে চেয়ারে বসতে হয় তখন চেয়ার তার অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে এটাই স্বাভাবিক।

যুব মহিলা লীগের সভাপতি বলেন, খুব শিগগিরই আমরা সারাদেশে যুব মহিলা লীগের সাংগঠনিক রিপোর্ট সংগ্রহ করে কিছু কর্ম-পরিকল্পনায় সামনে অগ্রসর হতে চাই। সে ক্ষেত্রে প্রথমে মেয়াদহীন কমিটি, বিতর্কিত, নিষ্ক্রিয় কমিটিগুলো তালিকাবদ্ধ করে তা কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলব। এমনকি সংশ্লিষ্ট এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের পরামর্শ নেব। তাছাড়া পাপিয়া (যুব মহিলা লীগের বিতর্কিত নেত্রী) বের হলে কেউ দায়িত্ব নেয় না। তখন (নেতাদের পরামর্শ নিলে) এ ধরনের কিছু হলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ দায়ভার নেবে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে অনেক সময় সঠিক মূল্যায়ন করা যায় না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী যুব মহিলা লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল সোনালী বার্তাকে বলেন, প্রভাব থাকতেই পারে। নিজের হাতে তৈরি করা সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকবে সারা জীবন। অভিযোগ দিতে পারে। তবে কে কি অভিযোগ দিয়েছে আমি কিছুই জানি না। প্রায় দুই মাস ব্যস্ত ছিলাম নির্বাচন ঘিরে। এলাকায় ছিলাম।

তিনি আরো বলেন, সুবিধা-অসুবিধার কথা তারা তো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছেই বলবেন। কারোও বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে হলে তথ্য প্রমাণ সাপেক্ষে দিতে হয়; সেক্ষেত্রে যারা অভিযোগ দিয়েছে তারা কি তথ্য প্রমাণ দিয়েছে?

সোনালী বার্তা/এসআর


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
এক ক্লিকে বিভাগের খবর